ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত ফাতিমা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত ফাতিমা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা

হযরত ফাতিমা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহার পূর্ণ নাম ফাতিমা তুজ জোহরা। তিনি প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ও হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহার প্রিয় কন্যা। তিনি ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত আলী করমুল্লাহু ওয়াজহাহুর প্রিয় স্ত্রী। তিনি ছিলেন হযরত ইমাম হাসান রাদিআল্লাহু ও ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু এর শ্রদ্ধেয় আম্মাজান। তার জন্ম হয় প্রিয় নবী সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট হিরা গুহায় ওহি নাজিল হওয়ার পাঁচ বছর পূর্বে । হযরত ফাতিমা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহা সার্বক্ষণিক প্রিয়নবী মহুম্মদ সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ৬২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ রমাদান হযরত খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করলে প্রিয় নবী (সা.) স্ত্রী বিয়োগে কাতর হয়ে পড়েন। তখন হযরত ফাতিমা (রা.) প্রিয় নবী (সা.)-কে সান্ত¦না দেন এবং নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী (সা.) এবং তার সঙ্গী-সাথীরা আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনা মনোয়ারায় হিযরত করলে হযরত ফাতিমা (রাদি) হযরত আলী (রাদি) মতান্তরে হযরত যায়েদ বিন্্ হারিসার সঙ্গে মদিনায় হিযরত করেন। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদরের যুদ্ধের পর ২৪ রমাদান প্রিয় নবী (সা.) হযরত আলীর সঙ্গে তাঁর প্রিয় কন্যাকে বিয়ে দেন। এর আগে অনেকেই ফাতিমা (রা.)- কে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশ পেয়ে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) ফাতিমা (রা.) বলেছিলেন, আমি তোমার শাদি আলীর সঙ্গে দেয়ার আদেশ পেয়েছি এ ব্যাপারে তোমার সম্মতি চাই। এ কথা শুনে হযরত ফাতিমা (রাদি) কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আব্বা আপনি আমাকে একজন দরিদ্র কুরায়েশের হাতে সমর্পণ করতে যাচ্ছেন! হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : সেই মহান সত্তার কসম যিনি আমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর থেকে অনুমতি না পেলে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতাম না। তখন হযরত ফাতিমা (রা.) বললেন : আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.) যাতে রাজি, আমিও তাতে রাজি। এরপর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে বললেন : তোমার কাছে কি আছে? তিনি বললেন : একটি ঘোড়া এবং একটি বর্ম। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ঘোড়াটি তোমার কাজে লাগবে। বর্মটি বিক্রি কর, তিনি বর্মটি চার শ’আশি দিরহামে বিক্রি করে প্রাপ্ত মূল্য এনে প্রিয় নবী (সা.)-এর কোলের ওপর রাখলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কিছু দিরহাম হযরত বিলাল রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর হাতে দিয়ে বললেন : বাজার থেকে খুশবু কিনে আনো। হযরত বিলাল (রা.) খুশবু কিনে আনলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে তিনি হযরত আনাস (রা.) হযরত আবু বকর (রা.) হযরত উমর (রা.) হযরত উসমান (রা.) হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.)-সহ বেশ কয়েকজন মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামকে ডেকে আনলেন। হযরত আলী (রা.) তখনও মজলিসে উপস্থিত হননি। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খুত্বা পাঠ করে বললেন ফাতিমাকে আলীর সঙ্গে শাদি দেয়ার নির্দেশ আমি আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছি। তোমরা সাক্ষী হও যে, আমি চারশ’ মিশকালে রুপার মোহরানার ইওয়াজে ফাতিমাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি, যদি আলী তা কবুল করে। ঠিক সেই মুহূর্তে মজলিসে আলী (রা.) হাজির হলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আবার ওই কথাগুলো হযরত আলী (রা.)-কে শুনিয়ে বললেন, আলী! তুমি কি এটা কবুল করেছ? হযরত আলী (রা.) বললেন, আলহামদুুলিল্লাহ, আমি আল্লাহর সব নিয়ামতের শুকোর গুজারি করছি এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।’ ইয়া রাসূলুল্লাহ। আমি তাকে কবুল করলাম। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : আল্লাহ তোমাদের মিলন দান করুন, তোমাদের চেষ্টাকে ফলবতী করুন, তোমাদের ওপর বরকত বর্ষণ করুন, তোমাদের পবিত্র সন্তান-সন্ততি দান করুন। এরপর এক ঝুড়ি খেজুর এনে তিনি মজলিসের সবাইকে বললেন এর থেকে তোমরা লুট করে খাও। মজলিসের সবাই ঝুড়ি থেকে কাড়াকাড়ি করে খেজুর তুলে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে তা খেতে লাগলেন। প্রিয় নবী সরদারে দো-আলম নূরে মুজাস্্সম হযরত মুহম্মদ (সা.) হযরত ফাতিমা (রা)-কে জেহেজ দিলেন ঝাউকাঠ দিয়ে তৈরি একটা খাটিয়া, খেজুরের পাতা ভরা একটি চামড়ার বালিশ, ছাগলের চামড়া ও ভেড়ার চামড়ার দুটো মশক, আটা পেষার জন্য যাঁতা, দুটো মাটির কলসি। আর হযরত আলী (রা.)-কে দিলেন একটি মেষ চর্ম ও একখানি পুরনো ইয়ামনী চাদর। তারপর রূনুমায়ী (বর-কনের মুখ দর্শন) হলো। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (রা)-কে বললেন : আমি না আসা পর্যন্ত তুমি ফাতিমার সঙ্গে কথা বলবে না। রাতে প্রিয় নবী (সা.) বাসর ঘরে ঢুকে ফাতিমা (রা.)-কে বললেন : মা, এক পেয়ালা পানি নিয়ে এসো। হযরত ফাতিমা (রা.)-এর পা হাঁটতে গিয়ে লজ্জায় ওড়নায় জড়িয়ে যাচ্ছিল। তিনি কাঠের পেয়ালায় পানি ভর্তি করে আনলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পেয়ালার কিছুটা পানি মুখে নিয়ে আবার তা পেয়ালাতেই রাখলেন। তিনি কন্যাকে তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াতে বললেন। তখন তিনি ফাতিমা (রা.)-এর মাথায় ও বুকে ওই পেয়ালার পানি হাতে নিয়ে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর দোয়া করলেন এবং সমস্ত পানি ফাতিমার দুই কাঁধে ঢেলে দিলেন। তারপর হযরত আলী (রা.)-কে আর এক পেয়ালা পানি আনতে বললেন। হযরত আলী পানি নিয়ে এলে একইভাবে আলীর ওপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে দোয়া করে বললেন, আল্লাহুমা বারিক ফীহিমা ওয়া বারিক লা হুমা ফী শামলিহিমা। তারপর সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে এই নব দম্পতির জন্য দোয়া করে বললেন : বিস্মিল্লাহি ওয়া বারাকাতিহি। অতঃপর হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহুকে বললেন : আপন স্ত্রীর সমীপবর্তী হও। এই বলে তিনি বাইরে এলেন। আসার সময় তিনি কন্যা ফাতিমা (রা.)-কে বললেন : মা আমার বংশের উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে তোমার শাদি দিলাম। বিয়ের তিনদিন পর হযরত আলী (রা) ওয়ালিমা (বউভাত) অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। তাতে খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল যবের রুটি এবং দুম্বার গোশ্ত। এ ছাড়া ছিল খেজুর এবং ঘি ও খেজুর দিয়ে তৈরি হায়স নামক এক উন্নত মানের হালুয়া। হযরত আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.) দম্পতিরই পুত্র হচ্ছেন হযরত হাসান (রা.) ও হরযত হুসাইন (রা.)। যাদের সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন : এরা জান্নাতের যুুবকদের সরদার। হযরত ফাতিমা (রা.) সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন : ফাতিমা জান্নাতবাসী নারীদের নেত্রী। তাকে খাতুনে জান্নাত বলা হয়। তিনি বাতুল কেতাবে ভূষিত ছিলেন। প্রিয় নবী (সা.) শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে হযরত ফাতিমাকে বলেছিলেন তুমি আমার পরিবারের মধ্যে প্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত ফাতিমা (রা.) ইন্তেকাল করেন। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×