ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকের এটিএম মেশিন আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি

প্রকাশিত: ১১:২৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ব্যাংকের এটিএম মেশিন আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি

রহিম শেখ ॥ ব্যাংক খাতের অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) ও ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন (সিআরএম) আমদানিতে মূল্য কম দেখিয়ে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির মতে, কাস্টমস ও ব্যাংকের তথ্যে বিস্তর ফারাক। সম্প্রতি এনবিআর দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে এটিএম মেশিন আমদানি ও কেনার তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়। জবাবে ব্যাংকগুলো যে তথ্য দেয় তাতে ঘোষিত ও প্রকৃতমূল্যে ব্যাপক গরমিল পেয়েছে এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সংস্থাটি বলছে, শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে রফতানিকারকদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অংকের বাকি অর্থ পাঠানো হতে পারে। এদিকে শুল্ক ফাঁকির পাশাপাশি নিম্নমানের এটিএম মেশিন আমদানি করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটিএম কার্ড স্কিমিং, কার্ড ক্লোনিং ও সর্বশেষ ‘জ্যাকপট’ ম্যালওয়্যার দিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, ’১৬ সালে ব্যাংকিং খাতের অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছিল এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু সে প্রক্রিয়া রহস্যজনক কারণে মাঝপথে থেমে যায়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ব্যাংকিং খাতের জন্য আমদানি হওয়া এটিএম, সিডিএম, সিআরএম, আইডিএম, সিএসএম, এসটিএম ও আইডিএমসহ ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রযুক্তি পণ্য সরবরাহকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে এনবিআর। সম্প্রতি এনবিআরের পক্ষ থেকে এটিএম বুথ আমদানির তথ্য চেয়ে দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠির জবাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জবাব দেয় তাতে বড় ধরনের গরমিল খুঁজে পায় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কাস্টমস থেকে আমরা এটিএম মেশিন আমদানির প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করেছি। এতে ঘোষিত ও প্রকৃতমূল্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে এটিএম আমদানির আড়ালে বিপুল শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে এখন ১০ হাজারের বেশি এটিএম মেশিন সচল রয়েছে। এর মধ্যে বেশি আমদানি করেছে টেকনোমিডিয়া লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো অন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা। এ বিষয়ে টেকনোমিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথের সঙ্গে মঙ্গলবার টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এছাড়া জারা জামান টেকনোলজি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঋণপত্র বা এলসিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে চীন থেকে আমদানি হওয়া এটিএম ও সিআরএম মেশিনের ক্রয়মূল্য কম দেখানোর প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশের কোন কোন ব্যবসায়ী কম্পিউটার যন্ত্রাংশের নাম দিয়ে অথবা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এটিএম আমদানি করত। কম্পিউটার যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক না থাকায় এ পথ বেছে নেয় তারা। পরে এনবিআরের কড়াকড়ির কারণে ব্যবসায়ীরা এ পথ থেকে সরে এসে ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এটিএম মেশিন আমদানি শুরু করে। জানা যায়, চীনা একটি এটিএম মেশিনের (শুধু টাকা তোলা) ফ্যাক্টরি থেকে রফতানিমূল্য ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এলসিতে ওই পণ্যের দাম দেখাচ্ছে মাত্র এক লাখ টাকা। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে তা আবার বিক্রি করা হচ্ছে ৫ লাখ টাকার বেশি দামে। অপরদিকে, একটি চীনা রিসাইক্লার এটিএম মেশিনের (টাকা তোলা ও জমা দেয়া) ফ্যাক্টরি থেকে রফতানিমূল্য ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা তা মাত্র ২ লাখ ১২ হাজার ৫শ’ টাকায় আমদানি দেখাচ্ছে। দেশী ব্যাংকগুলো এসব মেশিন ন্যূনতম ২০ লাখ টাকায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনছে। এক্ষেত্রেও রফতানিকারকদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অংকের বাকি অর্থ পাঠানো হয়েছে। এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত এনসিআর কর্পোরেশনের এটিএম মেশিনের দাম ১০ লাখ টাকার বেশি হলেও ব্যাংকগুলো মাত্র ৫/৬ লাখ টাকার এটিএম মেশিন বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছে। এ কারণে জালিয়াত চক্র এসব মেশিন সহজেই ক্লোন করতে পারছে। চক্র তাদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের ভেতরেও ক্লোন করেছে, আবার দেশের বাইরে থেকেও ক্লোন করেছে। বাংলাদেশে যেসব এটিএম মেশিন ব্যবহার হয়ে আসছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর মেশিনের সংখ্যা চার হাজার সাত শ’ ৭৩, জার্মানির উইনকোর মেশিনের সংখ্যা আড়াই হাজার এবং অন্যান্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মেশিনের সংখ্যা চার শ’। উল্লেখ্য, এটিএম মেশিন আমদানিতে শুল্কের পরিমাণ ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শুধু শুল্ক ফাঁকি নয়, অনেক সময় তথ্য গোপন করেও এটিএম মেশিনের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে যে পরিমাণ এটিএম আমদানির তথ্য রয়েছে বাজারে প্রকৃত এটিএমের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ মনে করছে, চোরাচালানের মাধ্যমে তৃতীয় কোন দেশ থেকে এসব মেশিন বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে ব্যবহৃত এটিএম ও সিআরএমসহ সব প্রযুক্তি পণ্য আমদানির আড়ালে অনিয়ম খতিয়ে দেখতে তদন্ত চলছে। এ জন্য সব ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের শুল্ক ফাঁকি উদঘাটন ও অর্থপাচার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। শুল্ক ফাঁকির পাশাপাশি নি¤œমানের এটিএম মেশিন আমদানি করার এটিএম কার্ড স্কিমিং, কার্ড ক্লোনিং ও সর্বশেষ ‘জ্যাকপট’ ম্যালওয়্যার দিয়ে গ্রাহকের সাম্প্রতিক অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো কম দামী ও নি¤œমানের এটিএম বেশি স্থাপন করেছে। এর একটা বড় অংশ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়েছে কম্পিউটার যন্ত্রাংশের কথা বলে। অধিকাংশ এটিএম মেশিন আমদানিতে শুল্ক পরিশোধ করা হয়নি। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ দেখিয়ে এসব এটিএম মেশিন আমদানি করা হয়েছে। অপরদিকে অটোমেটেড ট্রেলার মেশিনের (এটিএম) অপারেটিং সিস্টেম দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে বিপুল অর্থ হ্যাক করে নিচ্ছে হ্যাকাররা। অথচ বর্তমান অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ এক্সপি ও উইন্ডোজ ৭ বদল করে অনায়াসেই এ ধরনের অর্থ হ্যাকিং রোধ করা সম্ভব। তবে এতে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো এটিএম মেশিন দিয়েই কাজ চালাচ্ছে ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, জালিয়াত চক্র ’১৬ সালের ৬ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে ১ হাজার ২শ’ গ্রাহকের তথ্য হ্যাক করে। এর মধ্যে ৪০ গ্রাহকের ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
×