ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মশার ওষুধ ক্রয়ে পদে পদে দুর্নীতি

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মশার ওষুধ ক্রয়ে পদে পদে দুর্নীতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ক্রয় কার্যক্রমে পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একইসঙ্গে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বা নিধনের জন্য কেনা ওষুধে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশের (ডিএনসিসি) চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ৪০ শতাংশ বেশি টাকা খরচ করেছে। টিআইবি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর ধানম-িতে টিআইবির কার্যালয়ে ঢাকা শহরের এডিস ‘মশা নিয়ন্ত্রণে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক মোহম্মাদ জুলকার নাইন এবং মোস্তফা কামাল। এছাড়া টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের পার্শ্ববর্তী প্রায় সব দেশের মধ্যেই রয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে লোক দেখানো অকার্যকর কার্যক্রম গ্রহণ এবং সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে বেসরকারী হিসাবে ২২৩ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া মশার ওষুধ ক্রয়ে প্রতিটি পদে পদে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যা কল্পনাতীত। এর আগে কখনও এমনটা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কর্পোরেশনের এলাকাভিত্তিক বা আঞ্চলিক কোন পরিকল্পনা ছিল না। দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ক্রয় কেনাসহ বার্ষিক পরিকল্পনায় অনিয়ম ছিল ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের। সংস্থাটির দরপত্র পদ্ধতি, নথি ও দাখিলেও অনিয়ম দেখা গেছে। কীটনাশক কেনার আগে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষায় অনিয়ম ও সীমাবদ্ধতা ছিল। মশক নিধন কার্যক্রমেও অনিয়ম দুর্নীতি আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি ডাকইয়ার্ড এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে লিমিট এগ্রো প্রোডাক্টের কাছ থেকে প্রতিলিটার কীটনাশক ৩৭৮ টাকায় সরাসরি কেনার কার্যাদেশ দেয়। একই প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) উন্মুক্ত দরপত্রে প্রতিলিটার কীটনাশক ২১৭ টাকায় দেয়ার প্রস্তাব করে। এ হিসাবে দক্ষিণ সিটির ক্ষতি হয়েছে প্রতিলিটারে ১৬১ টাকা। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ বেশি আর্থিক ক্ষতি করে দক্ষিণ সিটি কীটনাশক ক্রয় করেছে। গুণগত পদ্ধতিতে টিআইবি এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে দাবি করে। টিআইবি বলছে, প্রাক বর্ষা মৌসুমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ছিল ২১ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ছিল ২৬ শতাংশ। অথচ ২০ শতাংশের বেশি এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালেও দুই সিটির গড় ২০ শতাংশের বেশি ছিল। এটি ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে বেশি বলে তাদের অবহিত করেছিল আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ)। প্রতিবেদনে উঠে আসে ঢাকায় শুধু বেসরকারী হাসপাতালের সংখ্যা ছয় শতাধিক। রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর শুধু ৪০টি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালের তথ্য সংকলন করেছে। গুটি কয়েক হাসপাতালের খ-িত পরিসংখ্যান দিয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের হারের তুলনামূলক চিত্র দিয়ে পরিস্থিতির মাত্রা কম দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োজন হলেও শুধু রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। মশা নিধনে লার্ভিসাইডিং ৮০ শতাংশ ও এ্যাডাল্টিসাইডিং ৩০ শতাংশ কার্যকর হলেও লোক দেখানোর জন্য লার্ভিসাইডিংকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কারণ এই কার্যক্রমে ক্রয়ের সুযোগ বেশি এবং দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। তাছাড়া লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিচ্ছন্ন রাস্তাকে পরিষ্কার করে কর্মসূচী বাস্তবায়নের মতোও ঘটনা ঘটেছে। একটি সিটি কর্পোরেশনে অকার্যকর ওষুধ ও আরেকটিতে চার মাস ওষুধ শূন্য থাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, উত্তরের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ওষুধ নিয়েছে দক্ষিণ সিটি। কোম্পানিটি সঠিক সময়ে উত্তর সিটিতে ওষুধ দিতে না পারায় কয়েক মাস ওষুধ শূন্য ছিল ডিএনসিসি। কিন্তু এই কালো তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়াটি সঠিক ছিল কিনা সে সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীরা জানতে চাইলে টিআইবি জানায়, তারা (ডিএনসিসি) নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করে ওষুধকে মানহীন বলেছে। কিন্তু সেটি সঠিক পদ্ধতি ছিল কিনা তা জানতে পারেনি টিআইবি। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, ২০১৮ সালে উত্তর সিটির ৬৫২টি মেশিনের মধ্যে অর্ধেক মেশিন নষ্ট ছিল। বর্তমানে জরুরী পরিস্থিতিতে নতুন কিছু মেশিন ক্রয় করা ও কিছু মেশিন মেরামত করা হলেও এখনও ৪০-৪৫টি মেশিন নষ্ট। পক্ষান্তরে ডিএসসিসির ৯৪০টি মেশিনের মধ্যে ৪২৮টি মেশিন নষ্ট ছিল। অধিকাংশ নষ্ট মেশিনের যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে পাওয়া যায় না।
×