ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অচল রাজধানী ॥ দুঃসহ যানজট

প্রকাশিত: ১১:০৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অচল রাজধানী ॥ দুঃসহ যানজট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের আমলে দেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে ব্যাপক প্রশংসা করা হলেও ঢাকার যানজটের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালে রাজধানীতে ৩০ লাখ মানুষের বসবাস ছিল। এখন তা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮০ লাখে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ৩৫ ভাগই ঢাকা কেন্দ্রিক। ‘বাংলাদেশের নগরায়ন ও ঢাকার জীবনযাত্রা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজধানীতে যানজটের মাত্রা বাড়ছে। যানজট ও দূষণে ঢাকা বিশ্বের মধ্যে এখন তৃতীয় অবস্থানে। নগরীর যানজট নিরসন ও ঢাকামুখী মানুষের স্র্রোত কমাতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গৃহীত সকল পদক্ষেপও তুলে ধরা হয়েছে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় মাত্রাতিরিক্ত যানজটের কারণে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। কবে নাগাদ যানজট নিরসন সম্ভব হবে তা স্পষ্ট নয়। পুলিশ বলছে, রাস্তা কম। অথচ দেদার যানবাহন রেজিস্ট্রেশন চলছে। ঢাকায় রাস্তা অনুপাতে তিন লাখ যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। এখন রাজধানীতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) অনুমোদিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। অনুমোদনহীন যানবাহন কত এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এরসঙ্গে উন্নয়ন কর্মকা- চলছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে প্রায় দিনভর স্থবির থাকে নগরী। তাছাড়া যানজট নিরসনে উড়াল সড়ক নির্মাণ হলেও এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় নিচের সড়কে যানজটের চিত্র আগের মতোই। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ত্রুটি রয়েছে। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার বাড়তি চাপ তো আছেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে আগামী পাঁচ বছরে হাঁটার গতি ও যানবাহনের চলার গতি হবে সমান। এখন ঘণ্টায় সর্বোচ্চ চার কিলোমিটারের কিছু বেশি যানবাহন চলতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত যানজটের কারণে দিনে নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। যানজট কমাতে দশ বছরে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে সরকার। সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে ৬০ ভাগ যানজট কমানো যদি সম্ভব হয় তাহলে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। ইকোনমিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভূমিহীন, নদী ভাঙনের শিকার বা অভাবের কারণে সারাদেশ থেকে ঢাকামুখী মানুষের স্র্রোত বাড়ছে। ১৯৭৪ সালে নগর কেন্দ্রিক মানুষের বসবাস ছিল নয় ভাগ। ২০১৯ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৭ ভাগে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ১৭০ কোটি মানুষ শহরে বসবাস করছে। গত কয়েক দশকে শহরমুখী মানুষের বসবাস বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য সলিমুল হকের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসংখ্যার চাপ ঢাকায় বাড়ছে। গত দশকে ঢাকার উন্নয়ন হয়েছে ছয় দশমিক ৫ ভাগ। এর চেয়ে এই শহরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশি হয়েছে। দেশের মোট আর্থিক উন্নয়নের ৩৫ ভাগের উৎস ঢাকা সিটি। এখানে যারা কাজ করছেন তারাই এই উন্নয়নের রূপকার। গত ৩০ বছরে সব সরকারই ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে এ কথা উল্লেখ করে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা কিংবা শহরমুখী মানুষের স্র্রোত থামাতে গ্রামগঞ্জে আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উগ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি গ্রাম হবে শহর এই সেøাগানে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এখন গ্রামে গ্রামে আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার কাজ করছে সরকার। বিদ্যুত, ইন্টারনেটসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে। সেইসঙ্গে গ্রাম উন্নয়নে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। সরকারের লক্ষ, কর্মসংস্থান বাড়াতে আগামী এক দশকের মধ্যে দেশে ১০০টি ইকনোমিক জোন স্থাপন করা। যানজট সমস্যা সমাধানে মেট্রো রেল প্রক্রিয়াধীন এ কথা উল্লেখ করে ইকনোমিস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সমস্যা সমাধানে রাজউকের পাশাপাশি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর দক্ষিণে ভাগ করে কাজে লাগানো হচ্ছে। রাজধানীর প্রায় ২১ কিলোমিটার এলাকাজুড়েই মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান। যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে এ প্রকল্পটি নগরীতে এখন যানজটের মাত্রা বাড়াচ্ছে- এমন অভিযোগ সব মহলের। প্রকল্পের একপ্রান্ত হলো মতিঝিল। রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। মেট্রোরেলের কারণে মতিঝিল থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত রাস্তা অর্ধেক হয়ে গেছে। এটুকু অংশ বাসে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট! অথচ প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেও মতিঝিল থেকে প্রেসক্লাব পৌঁছাতে অন্তত এক ঘণ্টা সময় লাগত। অর্ধেক রাস্তা বন্ধ থাকলেও সড়কে যানজট নেই। কারণ হিসেবে পুলিশ বলছে, মতিঝিল থেকে পল্টন পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের কোথাও গাড়ি পার্কিং করতে দেয়া হচ্ছে না। থামতে দেয়া হচ্ছে না যান। দখলমুক্ত করা হয়েছে ফুটপাথ। তাই যানজট নেই। অন্যদিকে যানজটের বিষফোঁড়া হিসেবে পরিচিত এখন কাকরাইল, মগবাজার, মৌচাক, রামপুরা, সাতরাস্তাসহ আশপাশের এলাকা। যানজট নিরসনে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও সঙ্কটের সমাধান মেলেনি। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই উড়াল সড়কটির হলি ফ্যামিলি, ইস্কাটন, সাতরাস্তা, রামপুরা অংশে তীব্র যানজট দেখা গেছে। সব মিলিয়ে গোটা উড়াল সড়কজুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকে। কথা হলো একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও যানজটের ভোগান্তি থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলছে না। বরং দিন দিন সঙ্কট বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন ছাড়া সমস্যার সমাধান মিলবে না। রাজধানীমুখী মানুষের স্রোত যে কোন মূল্যে কমাতে হবে। জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করারও পরামর্শ দেন তারা। সে সঙ্গে আইন মানতে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। উদ্ধার করতে হবে দখল হওয়া ফুটপাথ, সড়ক। বাড়াতে হবে রাস্তা। কমাতে হবে প্রাইভেটকারের রেজিস্ট্রেশন। তবেই যানজট নিরসনে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে সমস্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট ॥ ঢাকা মহানগরীতে যানজটে প্রতিদিন ৩৮ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এ হিসাব ’১৭ সালের বিশ্ব ব্যাংকের। এক বছর পর ’১৮ সালে বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই অঙ্কটি ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। এ হিসাব এডিবির। যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা দেখিয়েছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, যা জাতীয় বাজেটের ১১ ভাগের এক ভাগ। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নগরীর যানজট যদি ৬০ শতাংশ কমানো যায় তবে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হবে। সম্প্রতি বুয়েটে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। ওই গোলটেবিলে অধ্যাপক মোয়াজ্জেম উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে যানজটের কারণে সময় নষ্ট এবং আর্থিক ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে বলেন, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে কমে নেমে এসেছে, যেখানে হেঁটে চলার গড় গতিও প্রায় ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ঢাকা শহরে গণপরিবহনগুলো প্রতিদিন ৩৬ লাখ ট্রিপে ৩৫ শতাংশ যাত্রীকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যানজট সম্পর্কে অধ্যাপক মোয়াজ্জেম বলেন, যানজটের কারণে মানব চরিত্রের নয়টি দিক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের সামাজিক যোগাযোগে প্রভাব পড়ছে। পরিবহনে শৃঙ্খলা জরুরী ॥ নগরের যানবাহন পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনতে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেন অধ্যাপক মোয়াজ্জেম। এখন ঢাকায় দেড় শ’ থেকে দুই শ’ বাস সার্ভিস চলছে। এটাকে প্রতিটি রুটে একটি করে কোম্পানিকে দায়িত্ব দিলে ভাল হয়। এতে সড়কে প্রতিযোগিতা কমবে। আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো সম্পূর্ণ সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শও দেন তিনি। তিনি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ডিটিসিএ, সিসিএস, রাজউক, আরএইডি, এলজিইডি ও বিআরটিএর মধ্যে একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দেন। প্রয়োজন পাঁচটি মেট্রোরেল ॥ আগামী ২০ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ ভাগ বাড়বে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে যানজট ও যানবাহনও। এ সময়ের মধ্যে নগরবাসীর দৈনিক যাতায়াত (ট্রিপ) বাড়বে প্রায় ৭১ শতাংশ, যা রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা বাড়াবে দ্বিগুণ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঢাকায় আগামী ২০ বছরে পাঁচটি মেট্রোরেল চালু করতে হবে। পাশাপাশি দুটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), নতুন কয়েকটি সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েও নির্মাণ করতে হবে। রাজধানীর যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সংশোধন সংক্রান্ত দ্বিতীয় পরবর্তী প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা ’৩৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৬৩ লাখে। এ সময় ট্রিপের সংখ্যা ২ কোটি ৯৮ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫ কোটি ১১ লাখে। কিন্তু বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থায় এ যাতায়াত সম্ভব নয়। ফলে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা তথা মেট্রোরেল ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য বর্তমানে চলমান প্রকল্পসহ রাজধানীতে পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণ করতে হবে। এতে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে প্রায় ২ হাজার ৫৬ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। যানজটের ১৯ কারণ, বলছে পুলিশ ॥ যানজট নিরসনে পুলিশ সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে দুই বছরের বেশি সময়। যেখানে রাজধানীতে যানজটের ১৯টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। পুলিশের প্রতিবেদনে অপ্রশস্ত রাস্তা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, গাড়ি পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে হাট-বাজার, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, দোকানপাট বসানো, সড়কে নির্মাণ সামগ্রী রাখা, আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবনে কার পার্কিং না থাকা, পার্কিং থাকলেও বন্ধ রাখা, রাস্তায় যত্রতত্র বাস, মিনিবাস ও অটোরিক্সা থামিয়ে যাত্রী উঠানো নামানো যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এছাড়া পুলিশ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সরকারী অন্য সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করা হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে ২১৯ বাস স্টপেজ এবং বিআরটিসি অনুমোদিত ২০৮ বাস রুট রয়েছে। বিআরটিসি ও বেসরকারী মিলিয়ে প্রতিদিন ১২ হাজার বাস/মিনিবাস এই রুটগুলোয় যাত্রী পরিবহন করে থাকে। বাস স্টপেজে বাস না থামিয়ে মূল রাস্তার ওপর বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। এছাড়া আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো নগরীর অভ্যন্তরে হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মহানগরী একটি অপরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। নগর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকার জমির মালিকদের ভূমি ব্যবহারে অদূরদর্শিতাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা শহরের ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ৮ শতাংশ ভূমি রাস্তা হিসেবে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি আদর্শ নগরীর জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ ভূমি রাস্তার জন্য প্রয়োজন হলেও ঢাকা মহানগরীর মাত্র ৮ শতাংশ ভূমি রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই ৮ শতাংশ রাস্তার মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় নিবন্ধিত ১৫ লাখ যান্ত্রিক যান এবং ৭ লাখ রিক্সা চলাচল করে, এসব রিক্সার মধ্যে ৬ লাখ ২০ হাজারই অবৈধ। চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা ব্যবহৃত রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বহু গুণ বেশি। নগরীর রাস্তায় ঠেলাগাড়ি থেকে রেলগাড়ি পর্যন্ত ৩০ ধরনের যান চলাচল করে। রাস্তায় দ্রুতগতি ও ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহন এবং একইসঙ্গে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের ফলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দশ বছরে ৪৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ॥ রাজধানীবাসীকে যানজটের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গত ১০ বছরে সরকার কী কী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে এ নিয়ে সংসদেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সংসদে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ঢাকা মহানগরীর যানজট সমস্যা নিরসনে গত ১০ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। গতি কমছে পরিবহনের ॥ বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৪ সালে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০১৮ সালে তা ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, যথাযথ পরিকল্পনা না করে শুধু একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পসর্বস্ব এসব উন্নয়ন দিন শেষে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফ্লাইওভারগুলোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এত টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানানো হলো। এখন দেখা যাচ্ছে, ফ্লাইওভারের উপরেও যানজট হচ্ছে। প্রকল্পসর্বস্ব উন্নয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করছেন তিনি। যানজটমুক্ত করতে সরকারের পরামর্শক নিয়োগ ॥ রাজধানীর যানজট সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গত ১০ বছরের বেশি সময়ে। কিন্তু কোন কিছুতেই সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। যানজট নিরসনে নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হলেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি ও মানুষের সংখ্যা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমাদের ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা কনসালট্যান্ট নিয়োগ দিয়েছি। তারাও পথ বের করতে চেষ্টা করছেন। আশা করছি শীঘ্রই মহানগরী যানজটমুক্ত করা সম্ভব হবে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ৭১ বিধিতে জরুরী গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে নোটিসের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নোটিস দেন নূরজাহান বেগম। আর্থিক ক্ষতি ৪৪ হাজার কোটি ॥ ঢাকায় প্রতিদিন ৩৭১ নতুন গাড়ি নামছে, যার সিংহভাগই ব্যক্তিগত। কিন্তু রাস্তা ততটা বাড়ছে না। নোটিসে বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের (বিআইও) গবেষণা তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, যানজটের কারণে বাংলাদেশে বছরে যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, তার মূল্য ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। এছাড়া উৎপাদন খাতে আর্থিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্য খাতে ২১ হাজার ৯১৮ কোটি, জ্বালানি ও যানবাহন মেরামত বাবদ ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ। জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি যথার্থই বলেছেন- প্রতিদিন ৩৭১ নতুন গাড়ি রাজধানীতে নামছে বা রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। আমরা বলেছিলাম রাজধানী যানজটমুক্ত করব। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। শুধু ঢাকা শহর নয়, সারাদেশে আমাদের রাস্তা আছে মাত্র ৮ শতাংশ অথচ থাকা উচিত ২৫ শতাংশ। সারাদেশ থেকে মানুষ ঢাকায় আসে। বর্তমানে রাজধানীতে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস এবং সকালে কিছু আসে রাতে চলে যাওয়ার সংখ্যাও অনেক। রাস্তা বৃদ্ধির জন্য আমরা বিভিন্ন প্রকল্প নিচ্ছি, নিয়েছি। ঢাকার যানজট নিরসনে কাজ করতে চায় কোরিয়া ॥ নিজ দেশে যানজট নিরসনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা ‘যানজট’ নিরসনে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (কোইকা) সভাপতি লি মি কিউং। রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে কারিগরি সহযোগিতা দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠককালে তিনি এ আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঢাকার যানজট ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন লি মি কিউং। রাজধানীর যানজট নিরসনসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে কাজ করতে কোইকা সভাপতির আগ্রহের কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় এক সময় যানজট অন্যতম সমস্যা ছিল। এখন সে দেশে যানজটের সমস্যা নেই। চার প্রকল্পে সঙ্কটের সমাধান মিলবে ॥ ঢাকার উন্নয়নে কাজ করছে সরকারের আট মন্ত্রণালয়ের ২৬ বিভাগ। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংক বলছে, সংখ্যাটি বড় হলেও এগুলোর মধ্যে রয়েছে সমন্বয়ের ঘাটতি। ফলে জলাবদ্ধতা, যানজট ও অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ঢাকাবাসী। তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে দেখছেন। তার মতে, ঢাকায় মেট্রোরেল, বিআরটির মতো বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যানজট নিরসনে তা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। সবক’টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকার যানজটের চিত্র একেবারে বদলে যাবে। ২১ থেকে ২৪ এর অপেক্ষা ॥ মহানগরীতে যানচলাচল নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে এমআরটি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিভিন্ন সড়কে ফ্লাইওভার ওভারপাস, ইউলুপ, একমুখী চলাচল ব্যবস্থা, ফুটপাথে অবৈধ দখলমুক্ত, মোবাইলকোর্ট পরিচালনা, সড়ক প্রশস্তকরণ সহ অটোমেটিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা। এসব পদক্ষেপ একযোগে বাস্তবায়ন করতে পারলে মহানগরী যানজটমুক্ত হবে, গাড়ি চলাচলে গতি আসবে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ ’২৪ সালের মধ্যে ২১ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজ সম্পন্ন হলে ঘণ্টার ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে। তাছাড়া যানজট নিরসনে বিমানবন্দর থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ৪৭ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ও চক্রাকার নৌপথ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। এছাড়া পাতাল রেল নির্মাণের পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে চারটি পরিবহন কোম্পানির আওতায় রাজধানীতে বাস চলাচল শুরু হলে রাস্তার চিত্র বদলে যাওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ খবর হলো নাম্বিও নামের একটি গ্লোবাল ডেটাবেসের সমীক্ষায় ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক যানজটের শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর আগের দুই বছর ঢাকার স্থান ছিল দ্বিতীয়, ২০১৬ সালে ছিল তৃতীয়। অর্থাৎ এই সমীক্ষা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, ঢাকা মহানগরের যানজট অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে।
×