ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়

আজ ২৬ সেপ্টেম্বর ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে এই দিনে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাসমর্থিত খন্দকার মোশতাক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালীন ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের স্বাক্ষর রয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। একটি হত্যাকা- সংঘটিত হলো আর তার বিচার হবে না? রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বোচ্চ অবস্থান গ্রহণ করে আইন প্রণয়ন করে হত্যাকা-ের বিচার বন্ধ করে দেবে– এটা কি করে সম্ভব? খুনীরা প্রকাশ্যে খুন করার বাহাদুরী করবে আর একটি রাষ্ট্র, একটি জাতি, একটি সমাজ শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে? আইনের শাসন পথ হারাল কোথায়? সুশীল সমাজের বিবেক কি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছিল সেদিন? রাজনীতির হাল ধরা স্লোগান মুখরিত কণ্ঠগুলো সব কি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল? আর বিশ্ব? নিহতদের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ কি ছিল না সেদিন? ষড়যন্ত্রের কালিমা মাথায় মেখে আমরা রক্তের হোলি খেলা খেললাম! কি আশ্চর্য! জাতির পিতার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে এই জাতি ভবিষ্যতের শান্তির নীড় বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারল কিভাবে? মসনদের আশায়? এরপর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হয়। পঞ্চম সংশোধনীটি নিজে কোন আইনের সংশোধনী নয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সকল অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে আইনী বৈধতা দান করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মূলকথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখসহ ওই দিন থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত (ওই দিনসহ) সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের যে কোন ঘোষণা বা আদেশ বলে সম্পাদিত সংবিধানের সকল সংশোধনী, সংযুক্তি, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলুপ্তি বৈধভাবে সম্পাদিত বলে বিবেচিত হবে এবং কোন কারণেই কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনালে এসবের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। এভাবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা পাকা-পোক্তভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়। কেন পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তির কথাটি বললাম তার যথেষ্ট কারণ আছে। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অতএব, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিল না। কিন্তু ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতে কেউ যাতে ১৫ আগস্ট খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থাটিকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ পরিণত করা হল। একই সঙ্গে এটাও বোঝানো হলো যে, যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এটি আর পরিবর্তন করা যাবে না। আর এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনীরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত। যে কোন হত্যাকা-ের বিচার হওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরী। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তবে তার দায়ভার নিতে হবে গোটা জাতিকে। কিন্তু আমার মনে আরও প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা বড় বড় নেতারাসহ সারাদেশের কর্মীরা তখন জীবনপণ লড়াই কেন করেনি? কিসের ভয়ে? মৃত্যুর ভয়ে? বীরের আবার মৃত্যু হয় নাকি? বর্তমানের নামকরা অনেক মানবাধিকার কর্মীর মনে হয়নি যে দেশ রসাতলে যাচ্ছে? কথায় কথায় মানববন্ধন করা সুশীল মানব-সন্তানরা কেন সেদিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে রাজপথে নেমে আসেনি? আচ্ছা, তখনকার দেশ-বিদেশ খ্যাত ব্যারিস্টার সাহেবরা, সংবিধান বিশেষজ্ঞরা নিদেনপক্ষে সংবিধান লঙ্ঘনের একটা মামলাও কি করতে পারলেন না? ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬Ñ এক সুদীর্ঘ ২১ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। অতঃপর, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তার রিপোর্টে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যেÑ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীকালে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং, কমিটির মতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা সম্ভব। কমিটির এই রিপোর্ট আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীরের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল এ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল সংসদে উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। আর সেই সঙ্গে সুগম হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় একটি ফোজদারি মামলা দায়েরের মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে পনেরো (১৫) জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আসামি পক্ষের পনেরো জন উচ্চ আদালতে আপীল করেন। আপীলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয় এবং ৩ জনকে খালাস দেয়া হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপীলের মাধ্যমে এর বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপীল শেষে বারো জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে এদের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাকি ছয় জন এখনও বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক অবস্থায় আছেন। পলাতকদের মধ্যে একজন এরই মাঝে বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, ঢাকায় একটি সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে ১৯৭৭ সালে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক রিট মামলাকে কেন্দ্র করে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বিষয়টি আদালতের সামনে আসে। ঐ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট। ফলে আবারও প্রমাণিত হলো সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী যা নাকি ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রণীত কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে ধারণ করেছিল, তা অবৈধ এবং অসাংবিধানিক। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ইতিহাসের একটা লম্বা সময় আমরা কলঙ্কিত অধ্যায় পার করেছি এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বহন করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আমাদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে। আর সেই ভূতকে সংসদীয় আইনের মাধ্যমে আমরা বাতিল করেছি ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর। বিচার বিভাগ এই কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সুতরাং কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভূত থেকে রেহাই পেতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় ৩৫ বছর। আমাদের রাষ্ট্রের বয়স এখন প্রায় ৪৮ বছর। এই ৪৮ বছরের ৩৫ বছরই আমাদের লেগে গেছে কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভূত তাড়াতে। আর তাই, আজকের এই দিনটিÑ ২৬ সেপ্টেম্বর, কখনই ভুলবার নয়। ইতিহাসের এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের অবসান হয়েছে সত্যি, কিন্তু জাতির জাতীয় জীবনে এই কলঙ্কের দাগ মুছে ফেলা এতটা সহজ নয়। লেখক : আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক
×