ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৩৫৯ বছরের মোগল স্থাপনা, ধ্বংসাবশেষও ধ্বংসের পথে

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

৩৫৯ বছরের মোগল স্থাপনা, ধ্বংসাবশেষও ধ্বংসের পথে

মোরসালিন মিজান ॥ বহুকাল আগে ১৬৬০ সালে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। আর আজ ২০১৯ সাল। প্রায় ৩৫৯ বছর আগের স্থাপনা। যে সে কথা নয়। এতদিনে মূল সেতুটি, হ্যাঁ, ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এক সময় যে ছিল, সেই স্মৃতিচিহ্ন রয়ে গেছে এখনও। প্রতিনিয়ত অযতœ অবহেলার শিকার হচ্ছে। সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেই। এর পরও কয়েকটি টুকরো সম্পর্কহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কতদিন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। গত কয়েকদিন আগে সেতুর অবশিষ্ট তিন অংশের একটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এর পর থেকেই নতুন করে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। ধ্বংসাবশেষও ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অবশিষ্ট দুটি স্মারক যে কোন মূল্যে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন ঐতিহ্যপ্রেমীরা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাগলা পুল মোগল আমলের স্থাপনা। রাজধানী শহর ঢাকার ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাগলা এলাকায় এটি নির্মাণ করা হয়। ধারণা করা হয়, বাংলার এগারোতম মোগল সুবেদার মীর জুমলার সময়কার স্থাপনা। তার সময়, অনেকেই জানেন, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় অনেক নতুন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। বড় উদাহরণ হয়ে আছে মীর জুমলার গেট বা ঢাকা গেট। একইভাবে তখন অনেক রাস্তা এবং সেতু নির্মাণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাগলা নামক স্থানে নির্মাণ করা হয় পাগলা ব্রিজ। সেতুটি ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জকে যুক্ত করতে ভূমিকা রাখে। ব্যবহারিক দিক ছাড়াও পাগলা পুলের নির্মাণশৈলী, নদীর দুই তীরের নান্দনিক সৌন্দর্য সাধারণকে মুগ্ধ করেছিল। বিখ্যাত পর্যটকদের লেখায়, আঁকা ছবিতে এই মুগ্ধতার কথা জানা যায়। ফরাসী পর্যটক ট্যাভারনিয়ার ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চল ভ্রমণে এসেছিলেন। তখন পাগলা ব্রিজ ও এর আশপাশের পরিবেশ মুগ্ধ করেছিল তাকে। তার বর্ণনাটি এরকম : ভাটিতে আছে আরেক নদী, পাগলা। নদীর ওপরে আছে সুন্দর একটি পুল। মীর জুমলা এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিছু তথ্যও পাওয়া যায় তার বর্ণনায়। নদীর দু’পাশে বেশ কিছু টাওয়ার ছিল এবং টাওয়ারগুলোতে ডাকাতের কাটা মু-ু ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এরও প্রায় ২০০ বছর পর ১৮২৪ সালে কলকাতার পর্যটক লর্ড বিশপ হেবার পাগলা পুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। অবশ্য ততদিনে সেতুটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অবশিষ্টাংশ দেখেই ফিরতে হয়েছিল তাকে। তারও কয়েক বছর পর ১৮২৭ সালে পাগলার পুলের একটি ছবি আঁকেন সে সময়ের বিখ্যাত পর্যটক ও শিল্পী চার্লস ড’য়লী। তাতেও দেখা যায়, সেতুটি কয়েক টুকরো হয়ে ধসে পড়ছে। আগাছায় ঘিরে আছে কংক্রিটের জঞ্জাল। এর পরও সৌন্দর্যটুকু অনুভব করা যায়। এ্যাটকিনসনের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, শক্রদের ওপর নজর রাখার জন্য পুলে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার যুক্ত করা হয়েছিল। এক ধরনের আলো-ছায়ার খেলা হতো এখানে। এর পর কত কাল গত হয়েছে! পাগলা পুলের অবস্থানও ভুল গিয়েছেন স্থানীয়রা। কিছুদিন আগে সেখানে গিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেও তেমন কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে শত প্রতিকূলতার মাঝেও পুলের বিচ্ছিন্ন তিনটি অংশ টিকে আছে দেখে মনে আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু মন খারাপ করা খবরটি আসে গত কয়েকদিন আগে। জানা যায়, পুলের যে অংশ স্থানীয় একটি মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ড্রেন নির্মাণের প্রয়োজনে এটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। না ভাঙলেও চলত কিনা, তা নিয়ে কেউ কোন কাজ করেছেন বলেও জানা যায়নি। বালুর মাঠে অবস্থিত গম্বুজের মতো দুটি কংক্রিটের কাঠামো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই ঘোরা ফেরা করছে বুলডোজার। দেখে শঙ্কিত ঐতিহ্যপ্রেমীরা। সাজ্জাদ রাশেদ পূর্বের ও বর্তমান সময়ের ছবি তুলে ধরে হেরিটেজ বাঁচিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন। আলোকচিত্রী মারুফ কিছুদিন আগে সেখানে গিয়ে পুলের ছবি তুলেছেন। তিনি বলছিলেন, যেভাবে মন্দির লাগায়ো অংশটি ভাঙ্গা হয়েছে তাতে বাকি দুটি অংশ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাগলা পুলের শেষ স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রাও।
×