ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেরানীগঞ্জে হুমকির মুখে কৃষি জমি

প্রকাশিত: ১২:২০, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কেরানীগঞ্জে হুমকির মুখে কৃষি জমি

সালাহ্উদ্দিন মিয়া, কেরানীগঞ্জ ॥ কেরানীগঞ্জের কৃষি জমি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এসব জমি প্রধানত আবাসন খাত, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন ও সেচের পানির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে । এতে যেমন কেরানীগঞ্জের কৃষি জমি কমছে তেমন উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। কৃষি জমি রক্ষায় আইন থাকলেও কেউ মানছে না। কৃষি জমিতে বালু ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। আবার কেরানীগঞ্জের অনেক জায়গাই খাল ভরাট করে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম সেচের পানির অভাব। পুরো কেরানীগঞ্জ জুড়ে সক্রিয় রয়েছে এক শ্রেণীর আমলা ও প্রভাবশালী মহলের ভূমিখেকোরা। যারা নিরীহ ও দরিদ্র কৃষকদের নানা কায়দায় বিপাকে ফেলে কম দামে হাতিয়ে নিচ্ছে কৃষি জমিগুলো। ঢাকার উপকণ্ঠে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ১৬৭ বর্গ কিলোমিটার সীমানা নিয়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলা। ঔপনেবিশিক আমল থেকেই এ অঞ্চলে মানুষের বসবাস থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, কৃষিকাজসহ জীবিকা উপার্জন ইত্যাদি কাজের জন্য ছিল মানুষের আনাগোনা। আধুনিক ঢাকার অতি নিকটে হওয়ায় ও ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের বিশেষ অংশ কেরানীগঞ্জের মধ্যে পড়াতে এবং সারা বাংলাদেশের রোল মডেল উপজেলা শহর হিসাবে তুলে ধরার জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প হওয়াতে বদলে গেছে কেরানীগঞ্জ উপজেলার ভূমির চিত্র। হঠাৎ করেই ভরে ফেলা হচ্ছে খাল-বিল, পুকুর, ডোবা-নালাসহ কৃষিজমিও। বসবাসের জন্য ভূমির চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে অন্যান্য খাতের ভূমিগুলোও অবৈধভাবে তৈরি করা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প, রাস্তা-ঘাটসহ হাট-বাজার ইত্যাদি । কেরানীগঞ্জ উপজেলাটিতে কৃষি জমির পরিমাণ হচ্ছে ৮৭২৫ হেক্টর। এ অঞ্চলের কৃষি জমিগুলোতে প্রধানত বোরো ধান, সরিষা ও বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করা হয়। আর এসব ফসলি জমি থেকে যা কিছু উৎপাদিত হয় তা ঢাকাসহ আশপাশের অঞ্চলের মানুষের চাহিদা পূরণ করা হয়। ঢাকার অতি সন্নিকটে হওয়ায় ও ঢাকা-মাওয়া পদ্মা সেতুর মহাসড়ক তৈরি হওয়াতে এখানে মানুষের আবাসনের জন্য ব্যাপক আকারে হাউজিং হচ্ছে। আর এসব হাউজিং প্রকল্পগুলো কোন নীতিমালা না মেনেই কৃষি জমি ধ্বংস করে গড়ে উঠছে। আর এতে করে কেরানীগঞ্জের কৃষিজমি থেকে প্রতি বছরই ০.৫৭ শতাংশ কমছে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিলেও কেরানীগঞ্জে এর ছিটা-ফোঁটা চোখে পড়ে না। যত্রতত্র ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাট করে নষ্ট করা কেরানীগঞ্জের হাজার হাজার বিঘা জমি। আর এতে বিপাকে পড়ছে কেরানীগঞ্জের হাজার হাজার মেহনতী কৃষক। আবার অনেকে সেচের পানির অভাবেও কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছে। এতে করে হুমকির মুখে পড়ছে কেরানীগঞ্জে কৃষি ব্যবস্থা ও পরিবেশ। সরজমিনে সারা কেরানীগঞ্জে ঘুরে দেখা যায়, এক সময় ৬৫টি খাল থাকলেও বর্তমানে ১৭/১৮টি খালের চিহ্ন পাওয়া যায় আর কেরানীগঞ্জের কৃষিজমিগুলো এ খালগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে খাল ও কৃষিজমিগুলো বলতে গেলে নেই। রাজেন্দ্রপুর এলাকার অভিজ্ঞ কৃষক মোহাম্মদ আলী জানায়, উপজেলার কিছু অসাধু কর্ম-কর্তার সহযোগিতায় একশ্রেণীর ভূমিদস্যু আছে যারা কৃষিজমি তাদের দখলে নেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে খাল ভরাট করে ফেলছে। খালগুলোতে ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে। আর এতে করে সেচের পানির অভাবে অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশার দিকে চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে অভিযোগ করে বলেন, বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ দেখি জমিতে বালু ভরাট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বলে পাশের জমিটা তাদের আর তাদের জমি ভরাট করতে গিয়েই আশপাশের বেশ কয়েকটি জমিতেও বালু ভরাট হয়ে গেছে। ভরাটকারীরা তখন আশপাশের যেসব জমি ভরাট করে ফেলেছে সেই ভরাটের টাকাও দ্বিগুণ-তিনগুণ চায়। অনেক সময় সেই বালু ভরাটের টাকা না দিতে পারলে জমি তাদের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। অনেকে প্রভাবশালীদের ভয়ে কমদামে তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই এসব এলাকার কৃষকদের দাবি কৃষি জমি রক্ষা করে পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প করা হোক ও কেরানীগঞ্জের সমস্ত খাল পুনরুদ্ধার করে কৃষি জমিতে সেচের পানির সুব্যবস্থা করা হোক। বছরের বিভিন্ন সময় কৃষকেরা মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ ও নানা কর্মসূচী করেও রক্ষা করতে পারছে না তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা কৃষিজমি। কেরানীগঞ্জের উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গ্রামীণ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও কৃষি জমি রক্ষায় নেই কোন উদ্যোগ। এ ব্যাপারে কেরানীগঞ্জ কৃষি অফিসার শহীদুল আমিন বলেন, আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি ব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে ঢেলে সাজিয়ে সবাইকে নিয়ে একত্রে কাজ করতে হবে। এখানে কৃষির ব্যাপারটা শুধু কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয় এতে সম্পৃক্ত আছে ভূমি মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়। সবাই একযোগে কাজ করতে পারলে কৃষি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া যাবে ।
×