ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাছের উৎপাদন বাড়াতে ব্রুড ব্যাংক

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মাছের উৎপাদন বাড়াতে ব্রুড ব্যাংক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গুণগত মানসম্পন্ন কার্প জাতীয় ও দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশে স্থাপন করা হয়েছে ব্রুড ব্যাংক। সরকারী ও বেসরকারী মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ ও পোনা উৎপাদনে ব্রুড ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ব্রুড মাছ বলতে প্রাপ্ত বয়স্ক কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন প্রজননক্ষম পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে বুঝায়। হ্যাচারিতে গুণগত মানসম্পন্ন পোনা উৎপাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নতমানের ব্রুড মাছ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দফতরের এক তথ্যে জানা গেছে, মৎস্য খাতের এই সমৃদ্ধির যুগেও, বাংলাদেশ যখন মৎস্য সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণ তখনও কিছু কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম উন্নত গুণসম্পন্ন পোনা উৎপাদনের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছের অপর্যাপ্ততার সেই সঙ্গে দেশীয় ছোট প্রজাতির মাছের (এস.আই.এস) বিলুপ্তির আশঙ্কা। এ সব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে মৎস্য অধিদফতর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ব্রুড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্প (৩য় পর্যায়)’ হাতে নেয়। যার উদ্দেশ্য ছিল সরকারী ও বেসরকারী মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুডমাছ ও পোনা মাছ উৎপাদন এবং উন্নত কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন কার্প ও দেশীয় ছোট প্রজাতির (এস.আই.এস) এর ব্রুড স্টক তৈরির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে প্রকৃতির উৎসের রেণু হতে (হালদা, পদ্মা, যমুনা নদী) ৩৫ মে.টন কার্প ব্রুড তৈরি করা হয়েছে এবং এসকল কার্পব্রুড হতে ৫০ মে.টন রেণু উৎপাদন করা হয়েছে যেখান থেকে পরবর্তীতে ৩০ লাখ কার্পের পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও গুলসা, পাবদা, শিং ও মাগুরের ০.২৮ মে.টন এস.আই.এস ব্রুড তৈরি করে সেখান থেকে ৩.১ লাখ পোনা উৎপাদন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় এ বছর প্রায় ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও বিগহেড কার্পের সর্বোচ্চ জেনেটিক গুণসম্পন্ন ৩৯ হাজার পোনা চীন হতে আমদানি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৪০ বছর আগে আশির দশকে বিদেশ থেকে কিছু কিছু প্রজাতির মাছ আমদানি করা হয়েছিল মাছ চাষ উন্নয়নে ব্রুডমাছ ও পোনামাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে। যার মধ্য এই তিনটি প্রজাতির মাছ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কম খরচ ও উৎপাদন বেশি হওয়ায় এই প্রজাতির মাছগুলো ব্যাপকভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এত বছরের ব্যবধানে এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে আন্তঃপ্রজনন হার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পরবর্তীতে উৎপাদিত পোনাগুলোর বৃদ্ধির হার ও গুণগতমান কমতে থাকে। এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে এবং ভবিষ্যতের জন্য গুণগতমানের পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনটি প্রজাতির প্রায় ৩৯ হাজার পোনা আমদানি করা হয়েছে। যেগুলোকে নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্রুড মাছে পরিণত করা হচ্ছে। পোনাগুলোকে আমদানির সময় এদের আকার ছিল ৩-৫ সেন্টিমিটার। মাছগুলো ‘আমুর’ নদীর যেটা চীন ও রাশিয়ায় মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাছগুলো তিন বছর খামারে প্রতিপালন করার পর ব্রুড মাছে পরিণত হবে। পরবর্তীতে মাছগুলো দেশের সকল সরকারী ও বেসরকারী খামারে ছড়িয়ে দেয়া হবে। ব্রুড ব্যাংক স্থাপন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের ৭টি বিভাগের ২৩ জেলার ২৭টি সরকারী মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে জানায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দফতর। এ প্রসঙ্গে ব্রুড ব্যাংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ সিরাজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মৎস্য চাষ ও চাষভিত্তিক জলাশয় ব্যবস্থাপনার ফলে গুণগতমানের পোনার চাহিদা হ্যাচারি উৎপাদিত পোনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গত দুই দশকে হ্যাচারিতে রেণু ও পোনা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বেসরকারী হ্যাচারি মালিকদের কারিগরি জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব, অধিক মুনাফার চিন্তাচেতনা, সঠিক প্রযুক্তি অনুসরণ না করা ,আন্তঃপ্রজনন ও সঙ্করায়ন সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার গুণগতমান বেশিরভাগই নি¤œমানের। ফলে মাছের উৎপাদন কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়ায় মৎস্য অধিদফতর কর্তৃক ব্রুড ব্যাংক স্থাপন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উন্নত কৌলিতাত্ত্বিক গুণাগুণসম্পন্ন ব্রুড মাছ ও মৎস্যবীজ উৎপাদনের জন্য ব্রুড ব্যাংক প্রকল্পটির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যাবশ্যক। বর্তমান সরকারের রূপকল্প- ২০২১ বাস্তবায়ন তথা সকল মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিতকরণে প্রকল্পটি ব্যাপক অবদান রাখবে। এছাড়া মাছচাষী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষসহ প্রায় ৩০ হাজার মানুষ নানা সুবিধা ভোগ করছে এ প্রকল্প থেকে। তাছাড়া মৎস্যচাষীরা চাইলে সরকারী মৎস্যবীজ খামার হতে উন্নতমানের পোনা সংগ্রহ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, ব্রুড ব্যাংক সফলভাবে স্থাপনের পর দেশের প্রায় ১ মিলিয়ন লোক এর সুফল ভোগ করবেন। মৎস্য অধিদফতরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব মতে, দেশে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৮৪৮ মেট্রিক টন কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছে। এটা মোট মাছ উৎপাদনের ৩৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর মধ্যে রুই, কাতলা , মৃগেলের মতো দামী কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৭ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে সিলভার কার্প , গ্রাস কার্প ও বিগ হেড কার্পসহ এ জাতীয় মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় এবং চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে ৫ম স্থান অর্জন করেছে। ব্রুড ব্যাংকের মাধ্যমে মাছ চাষ করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান ম-ল বলেন, বাংলাদের্শে আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টর অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এদেশের মৎস্যচাষকে সমৃদ্ধ ও টেকসই করার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন পোনার দরকার। আর এর জন্যই প্রয়োজন গুণগত মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ। বাংলাদেশ সরকারের ব্রুড ব্যাংক স্থাপন প্রকল্পটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
×