ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাংলার আগুন’ ॥ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:০২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 ‘বাংলার আগুন’ ॥ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এইদিন রাত ১২টা ৩০ মিনিট। নয়জন নৌকমান্ডো বঙ্গোপসাগরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত জাহাজের তলায় লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেয়। মাইন লাগানোর ৪০ মিনিটের মধ্যে জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে। ছোট বড় অনেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে ডুবে যায়। অপারেশন শেষে নয়জন নৌকমান্ডোর মধ্যে তিনজন ভুলে দিক হারিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় নেভাল বেইসে গিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাঁরা তিনজন হল সফিকুন নুর মওলা, নুরুল হক ও আমির হোসেন। অপর এক নৌকমান্ডো মোঃ হোসেন ফরিদের লাশ ভেসে উঠে। তিনজন নৌকমান্ডোকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়। ভোররাত ৩টা ৩০ মিনিটে এক কোম্পানি সৈন্য বল্লভপুরে পাকসেনাদের আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে আরেকটি দল চাম্পকনগরে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রমণের প্রথমে আর্টিলারি বাহিনী ১০ মিনিট গুলি চালায়। পাকসেনাদের শক্তিশালী ডিফেন্স প্রস্তুত ছিল এবং বাঙ্কারগুলোও প্রস্তুত ছিল। তাই আর্টিলারি বাহিনী ব্যর্থ হয়। এরমধ্যে পাকসেনারা আরও সৈন্য সমাবেশ করে ভারি আর্টিলারি দিয়ে করেরহাটে মুক্তিফৌজের অবস্থানগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। কয়েকবার চেষ্টা করে না পেরে শেষ পর্যন্ত মুক্তিফৌজ আক্রমণ বন্ধ করে। মুক্তিফৌজের একজন নিহত ও দুইজন আহত হয়। সন্ধ্যায় পশ্চিম দেবপুরে একটি এ্যামবুশে দুইজন পাকসেনা নিহত হয়। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা ও ১৬ জন গেরিলা লে. ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মর্টার ও রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে পাকহানাদার বাহিনীর গোবিন্দ মানিক্যদীঘি ঘাঁটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকসেনা ঘাঁটির কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকবাহিনীর একটি দল কুমারসাইল মসজিদের কাছে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানায় পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ৭৫ জন পুলিশ ও রাজাকারকে বন্দী করে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। ৬নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পঞ্চবিবির কাছে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। এতে ৬ জন পাকসৈন্য ও দুইজন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে পলাশী ব্যারাকে অবস্থিত পাকসেনা ক্যাম্পে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ২৯ জন পাকসেনাকে খতম করে। বাদ বাকি সেনারা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘বাংলাদেশ প্রশ্ন’ উত্থাপনের জন্য ভারত সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সপ্তাহব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে ফিরে আসার আগে নুরুল আমিন সাংবাদিকদের জানান, ‘পাকিস্তানের সংহতি ও অখ-তা সম্পর্কে নতুন আস্থা নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছি।’ বিবিসির খবরে সরকারী মুখপাত্র বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি আমেরিকান জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ জাহাজ চালনায় ধ্বংস হয়। ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিত করেছে যে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডুবুরিরা একটি ব্রিটিশ কার্গো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস সিডনি এইচ শ্যানবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশ করে লিখেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক শরণার্থীরা জানান যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের বেসামরিক সহযোগীরা হত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রেখেছে; যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যেÑ তারা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার এবং বাঙালীদের আস্থা অর্জনে ইচ্ছুক। এই প্রতিবেদক আজ বেশকিছু শরণার্থীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন, যারা সবাই গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। তাদের বর্ণনায় পাকিস্তানী সেনাসদস্য কর্তৃক বেসামরিক গণহত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে। যখন সীমান্ত থেকে চার মাইল, আর কলকাতা থেকে ৬০ মাইল উত্তরপূর্বের এই গ্রামে জনাকীর্ণ, অর্ধপ্লাবিত উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে শরণার্থীরা এসব কথা বলছিলেন, তখনও দিগন্ত থেকে বোমাবর্ষণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এটা বলা সম্ভব ছিল না যে, ঠিক কারা গোলাবর্ষণ করছে, পাকিস্তানী বাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী, না কি তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ এর মুক্তিবাহিনী। এই নামটি বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়েছে মার্চ মাস থেকে, যখন তাদের আন্দোলনকে রুদ্ধ করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। সাক্ষাতকার নেয়া অধিকাংশ শরণার্থী এসেছেন ফরিদপুর অঞ্চল থেকে, যেখানে বাঙালীর কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক নিবাস। তারা জানান, সামরিক সরকার হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তারা আরও বলেন, তাদের এলাকায় গেরিলাযোদ্ধারা সক্রিয় ছিলেন, এবং প্রত্যেক গেরিলা হামলার পর সেনাবাহিনী বেসামারিক লোকজনের উপর কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছে। নিরাপদ সাহা ফরিদপুর জেলার একজন পাট ব্যবসায়ী। তার নিজের গ্রামের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে নির্যাতনের বিবরণ দেন। গ্রামটি গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল। পাঁচ দিন পূর্বে তিনি পালিয়ে আসার আগে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামে হানা দেয়, প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ‘গ্রামের কিছু মানুষ যথেষ্ট তাড়াতাড়ি পালাতে পারেনি’, তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনারা তাদের ধরে ফেলে, এবং হাত পা বেঁধে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে। সাহা আরও জানান, গ্রামে প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু। এখন আর কোন ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই। পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, শরণার্থীদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ফেরত যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গেরিলা যোদ্ধাদের সাধারণ ক্ষমা করারও প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এই প্রতিশ্রুতি শরণার্থীদের কেবল তিক্ত হাস্যরসের উদ্রেক করে। ‘আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়েছি,’ বলেন রাজেন্দ্র দাস, আরেকজন কৃষক, ‘ওরা এখনও আমাদের হত্যা করে চলেছে। পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত আমরা আর ফেরত যাচ্ছি না। পশ্চিম জার্মানি থেকে প্রকাশিত দ্য ডেইলি ফ্রাঙ্কফুটারের ‘বাংলার আগুন’ শিরোনামের সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে জানা যায়, বাংলার চলমান দুর্দশার কোন সুরাহা এখনও পর্যন্ত হয়নি। সত্যিই কি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়? বিষয়টি অনেক আগেই এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখান থেকে এখন আর এটিকে নিছকই পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে গণ্য করা যাচ্ছে না। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থীদের মতো প্রচন্ড দুর্দশা ও অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাঙালীরাও। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরাও এখন পাকিস্তানের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে আন্দোলন মূলত পরিচালিত হয় ভারত থেকে। সম্মুখ যুদ্ধে সীমান্ত লঙ্ঘন হতেই পারে, কিন্তু হয়ত এটিই যুদ্ধের আগুনকে আরেকটু উস্কে দেবে। বর্ষা শেষ হতে হতে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকখানি ভাল অবস্থানে চলে আসার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে সংঘাতের সংখ্যাও আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং খুবই জরুরী ভিত্তিতে একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন যিনি অবস্থা আরও খারাপ হবার আগেই ভারত ও পাকিস্তানকে আলোচনার জন্য এক টেবিলে নিয়ে আসতে পারবেন। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থীদের কিভাবে দ্রুত ফেরত পাঠানো যায় সে বিষয়েও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। স্থায়ীভাবে তাদের দায়িত্ব নেয়া ভারতের জন্য একটি অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ‘প্রতিনিধিদলের সীমান্ত অতিক্রমের সিদ্ধান্ত বাতিল’ শিরোনামে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দিল্লীতে বাংলাদেশকে নিয়ে সদ্য-সমাপ্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ২৪টি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী ৩৫ জন প্রতিনিধি সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে দমদম এসে পৌঁছেছেন তারা তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। অস্ট্রেলীয় সংসদ সদস্য মি. লী জনসন ঘোষণা দেন যে পেট্রোপোল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে যাতে ‘বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ছাড়া অন্য আর কোন দেশ এই সমস্যার সঙ্গে জড়িত আছে এমনটা মনে না হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম অধিকার ক্ষুণœ হওয়াতে আমরা আমাদের অকৃত্রিম ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি তবুও আমরা মনে করি যে, এই মুহূর্তে সীমানা অতিক্রম করা অনুচিত হবে।’ পরবর্তী সময়ে এই প্রতিনিধিদল সল্টলেক শিবির পরিদর্শন করেন যেখানে ২৩২ হাজার জন শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। দুটি স্টেশন-ওয়াগন গাড়িতে করে তাদের ওই এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় বেলা ১টার দিকে। তারা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা দেখেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নরওয়ের অধিবাসী মি. এবং মিসেস হানিসদ্যাব। মিসেস হানিসদ্যাব বলেন, শরণার্থীদের দুর্দশা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নিজেও একজন শরণার্থী ছিলেন। তাই তিনি খুব ভালভাবেই জানেন শরণার্থী হওয়ার কষ্ট কাকে বলে। মিসেস ভিভিয়ান গুণোবর্ধন বলেন, তিনি শ্রীলঙ্কায় ফিরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিসেস বন্দরনায়েকের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন, যাতে সেখান থেকে পাকিস্তানী বিমানগুলোর তেল নেয়া বন্ধ করা হয়। ভারতের প্রশংসা করে তিনি বলেন, সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করলে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে তার স্বাধীনতা লাভ করা। সুদানের প্রতিনিধি মি. মোহাম্মেদ আলি সালিয়াহ বলেন যে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে এর স্বায়ত্তশাসন লাভ করাকে বেশি সুবিধাজনক মনে করেন। ড. এ সুরিয়ান মালায়শিয়ান, মালয়শিয়ার একজন সংসদ সদস্য। তিনি বলেন, বিশ্বের দেশগুলোর উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এক্ষেত্রে ভারতের উচিত স্বীকৃতিপ্রদানে নেতৃত্ব দেয়া। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×