ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে নিয়মিত টাকা দিতেন খালেদ মাহমুদ

প্রকাশিত: ১০:২৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে নিয়মিত টাকা দিতেন খালেদ মাহমুদ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বড় জুয়ার আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো চালানোর দায়ে গ্রেফতার যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বহুদিন দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে নিয়মিত টাকা দিতেন। তবে যুবলীগের পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়ার পর জিসানকে আর নিয়মিত টাকা দিতেন না। মতিঝিল, শাহজাহানপুর, বাসাবো, পল্টনসহ পুরো এলাকার ১০-১২ ক্লাব তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরমধ্যে বড় কয়েকটি ক্লাবে জুয়ার বড় আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো চলত। অন্য ক্লাবগুলোতে ছোট ছোট জুয়ার আসর বসত। সবই খালেদ মাহমুদ তার গড়ে তোলা সিন্ডিকেট দিয়ে চালাত। খালেদ মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদিকে শুক্রবার গুলশানের নিকেতন থেকে গ্রেফতার আরেক যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীমের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে গুলশান থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। তাকে অস্ত্র ও মাদক মামলায় পাঁচ দিন করে দশ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। তার সাত দেহরক্ষীকে অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলায় চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আর একইদিন কলাবাগান ক্রীড়াচক্র নামের ক্লাব থেকে ক্লাবটির সভাপতি কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে ধানমন্ডি থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। তাকে দুই মামলায় দশদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। অন্যদিকে অভিযানের কারণে যেসব ক্লাব ভয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সেসব ক্লাবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা চলছে। বন্ধ ক্লাবগুলোতে জুয়ার বোর্ড বা জুয়ার বড় আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনোর সরঞ্জাম আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এজন্যই তালাবদ্ধ ক্লাবগুলোতে এক এক করে অভিযানের প্রস্তুতি চলছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এদিকে ওয়ান্ডার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চলার বিষয়টি জানতেন না দাবি করে ক্লাবটির সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মোঃ আবু কাওছার বলেছেন, তিনি ক্লাবটির শুধু সভাপতিই ছিলেন। কিন্তু ক্লাব পরিচালনার কোন দায়িত্বে ছিলেন না। এছাড়া তিনি ক্লাবে খুব একটা যাতায়াত করতেন না। এজন্য তিনি ক্লাবে ক্যাসিনো নামের জুয়া চলার বিষয়টি একেবারেই জানতেন না। ডিবি হেফাজতে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে ॥ গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে জুয়া খেলা অবস্থায় নারী-পুরুষসহ ১৪২ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জব্দ হয় ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদি। সেখানে পাওয়া যায় মদ, ইয়াবা, নগদ টাকা, জালটাকাসহ অনেক কিছু। ক্যাসিনোটি চালানোর দায়ে ঢাকা মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ওইদিনই গুলশানের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারের সময় তার বাসা থেকে ৪শ’ পিস ইয়াবা ও প্রায় দশ লাখ টাকা এবং প্রায় ৬ লাখ টাকার ডলার পাওয়া যায়। তার কাছে ৩টি অস্ত্র পাওয়া যায়। যার মধ্যে একটি অবৈধ। অপর দুইটি অস্ত্র বৈধ লাইসেন্সের শর্তভঙ্গ করে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তার বিরুদ্ধে গুলশান মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের করেন র‌্যাব-৩-এর ওয়ারেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে তাকে অস্ত্র ও মাদক মামলায় সাতদিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড চেয়ে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম আদালতে সোর্পদ করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা অস্ত্র মামলায় চার দিন ও মাদক মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলাটির তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পেয়েছে। শনিবারই তাকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সূত্র বলছে, ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি মতিঝিল থানা পুলিশ, মতিঝিল জোন, পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপি সদর দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও জানতেন বলে খালেদের দাবি। শুধু তাই নয়, অনেক রাজনীতিবিদও জানতেন। যারা জানতেন তাদের নানাভাবে ম্যানেজ করেই ক্যাসিনো চালানো হতো। তবে এজন্য টাকা লেনদেন হতো কিনা, সেটি স্পষ্ট করেননি তিনি। এছাড়া কোরবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে রাতে মাছের একটি হাট বসাতেন। তিনি খিলগাঁও কাঁচাবাজারের সভাপতি। শাহজাহানপুরে রেলওয়ের জমি দখল করে দোকান ও ক্লাব নির্মাণ করতেন। এসব এলাকায় থাকা সরকারী প্রতিষ্ঠান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, রেলভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশিরভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে ঢাকার মতিঝিল, আরামবাগ, পুরানা পল্টন, বাসাবো, শাহজাহানপুর, বাসাবোসহ আশপাশের এলাকায় থাকা ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল খালেদ মাহমুদের হাতে। সব মিলিয়ে ১০-১২টি ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার কাছে। তিনি তার গড়ে তোলা নিজস্ব সিন্ডিকেট দিয়ে ক্লাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে সব ক্লাবে ক্যাসিনোর মতো জুয়া চলত না। ছোট ছোট ক্লাবগুলোতেও জুয়া চলত। সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করত তারই লোকজন। দুই একটি বড় ক্লাবে শুধু ক্যাসিনো চালাত। এসব ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি কারা কারা জানতেন এবং কারা কারা এজন্য অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে ক্যাসিনো থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকার একটি বড় অংশ দুবাইয়ে পলাতক থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে দিত। দীর্ঘদিন জিসানকে টাকা দিয়েছেন। পরবর্তীতে দলীয় পদ পদবী পাওয়ার পর আর নিয়মিত টাকা দিত না। মাঝে মধ্যে টাকা দিতেন। তবে তার মূল কাজ ছিল টেন্ডারবাজি। জি কে শামীমের বিরুদ্ধে তিন মামলা ॥ শুক্রবার গুলশানের নিকেতনের বাড়ি থেকে সাত দেহরক্ষীসহ গ্রেফতার হন জি কে শামীম। বাসা ও অফিসে পাওয়া যায় মদ, নগদ ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা, ডলার, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, সাতটি শর্টগান ও একটি পিস্তল ও বুলেট। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা দায়ের করে র‌্যাব। পরে তাকে গুলশান থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। শনিবার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম জি কে শামীমকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করেন দুই মামলায় সাতদিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আর তার সাত দেহরক্ষীকে অস্ত্র মামলায় সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত অস্ত্র ও মাদক মামলায় জি কে শামীমকে পাঁচদিন করে দশদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আর তার সাত দেহরক্ষীকে অস্ত্র মামলায় চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। দেহরক্ষীরা হচ্ছেন, দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, সহিদুল ইসলাম, কামাল হোসেন, সামসাদ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম। ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তার পৃথক পৃথক শুনানিতে এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ছিলেন যুবদলের ঢাকা মহানগরের সাবেক সহ-সম্পাদক। পরে তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। সে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পরিচয় দিতেন। যদিও যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে জি কে শামীম দলের কেউ নন বলে দাবি করা হয়েছে। ক্যাসিনো চালানোর দায়ে গ্রেফতারকৃত খালেদ মাহমুদের তথ্য মোতাবেক গ্রেফতার করা হয় জি কে শামীমকে। সে ঠিকাদারি ব্যবসায় বড় মাফিয়া বলে পরিচিত। এই কুখ্যাত ঠিকাদার টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন ভূঁইফোড় সংগঠনের কাছ থেকে ফিদেল কাস্ত্রো এ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা গোল্ড মেডেল, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল, মহাত্মা গান্ধী পিস এ্যাওয়ার্ড ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক নিয়েছেন। এসব করেছেন ব্যবসার প্রচার আর প্রসারের জন্য। কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবের সভাপতি দশদিনের রিমান্ডে ॥ শুক্রবার সন্ধ্যায় কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে ক্লাবের সভাপতি কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলমসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। সভাপতির কক্ষ থেকে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধার হয় বলে জানায় র‌্যাব। এছাড়া ক্যাসিনো জুয়া খেলার বেশকিছু কয়েন উদ্ধার হয়। তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে দুইটি মামলা দায়ের করেন র‌্যাব-২ এর পরিদর্শক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ খান। দুই মামলায় দশদিন করে ২০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে ঢাকা মহানগর আদালতে পাঠানো হয়। আদালত শুনানি শেষে দুই মামলায় ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জানা গেছে, শফিকুল আলম ফিরোজ বায়রার সিনিয়র সহ-সভাপতি। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, ক্লাব সভাপতির সঙ্গে আটক হওয়া অন্য চারজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাব থেকে নারী-পুরুষসহ ১৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিনই মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে প্রায় সোয়া দশ লাখ টাকা, জাল টাকা, ক্যাসিনো চালানোর নানা আলামত জব্দ হয়। একইদিন গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ও জুয়া খেলা অবস্থায় ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। চারটি অভিযানে ২০১ জন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৩১ জনকে এক বছরের এবং বাকিদের ৬ মাস করে কারাদ- দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। চারটি ক্যাসিনো থেকে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা উদ্ধার হয়। এছাড়া কষ্টিপাথরের মূর্তি, জাল টাকা, জুয়া খেলার সরঞ্জাম, ইয়াবা, বিদেশী মদসহ নানা ধরনের মাদক জব্দ হয়।
×