ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা হরফ রাখবে মান ভাষাশহীদদের আত্মদান

প্রকাশিত: ১০:১৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলা হরফ রাখবে মান ভাষাশহীদদের  আত্মদান

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ সুন্দর হাতে লেখার কদর সবাই করেন। হাতের লেখা সুন্দর হলে সকলেই প্রশংসার পাত্র হন। তাই হস্তাক্ষর সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাতের লেখা হচ্ছে বড় মানবসম্পদ। এ হাতের লেখা সুন্দর করার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার অনুপ কুমার দাস। তিনি হাতের লেখা সুন্দর করার একজন কারিগর। সুন্দর হাতের লেখার বিষয়ে অনুপ কুমার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন। ‘লেখব বাংলা সুন্দর করে ভাষাশহীদদের স্মরণ করে, বাংলা লেখায় (হরফে) রাখব মান ভাষা শহীদদের আত্মদান’-এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার অনুপ কুমার দাস দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কিভাবে হাতের লেখা সুন্দর করা যায় এর নানা কৌশল শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিখিয়ে চলেছেন। এ লক্ষ্যেই প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে সুন্দর হাতের লেখা প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিয়েছেন একাধিক ক্লাসও। চাষাঢ়ায় গড়ে তুলেছেন হাতের লেখা শেখানোর একটি স্কুল। অনুপ কুমার মনে করেন, শুদ্ধভাবে ভাষা উচ্চারণ করাটা যতটা প্রয়োজন সুন্দরভাবে লেখাটাও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষার্থীদের আগে সুন্দর হাতের লেখা শেখার প্রয়োজন শিক্ষকদের। শিক্ষকদের হাতের লেখা সুন্দর হলেই শিক্ষার্থীদের লেখা সুন্দর হবে। সুন্দর খেলার কারিগর অনুপ কুমার দাস লাল, নীল ও কালো কালি দিয়ে তার বাঁধাই খাতায় সুন্দর করে হাতে লিখে রেখেছেন, ‘শেখ হাসিনার বড় স্বপ্ন শিক্ষার্থীরা হবে শিক্ষায় মগ্ন, সুন্দর লেখায় রাখব রেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, শিক্ষার পরশমণি শেখ হাসিনা আপামণি, লেখব মোরা সুন্দর করে জাতিকে দিব অবাক করে, স্বপ্নীল লেখার রূপকার শেখ হাসিনা আবিষ্কার, সুন্দর লেখা রাখব ধরে জাতির পিতা ঘরে ঘরে, হাতের লেখায় রাখব মান, শেখ হাসিনার অবদান, কোনটি মোদের ভাল নীতি রাজনীতির চেয়ে শিক্ষানীতি’। অনুপ কুমার দাসের বয়স ষাটের কোঠায়। ১৯৭৮ সালের নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। কলকাতার নেতাজী নগর কলেজে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক পড়েছেন। স্নাতক পড়ার সময়ই নেতাজী ক্যালিগ্রাফি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে হাতের লেখার ওপর ছয় মাসের কোর্স করেছেন। এ কোর্সের মাধ্যমেই তার হাতের লেখা সুন্দর করার বাসনা জেগে ওঠে। ভারতে উচ্চ শিক্ষা শেষে কিছুদিন নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পরে তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরে ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে থাকেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা সুন্দর করার নানা কৌশল শেখানোর কাজটিও করে যাচ্ছেন। এতে তিনি ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন। অনুপ কুমার বলেন, আমাদের সরকার প্রতি বছর ৪০ কোটি বই বিনামূল্যে দিচ্ছে এটা সরকারের বিশাল কৃতিত্ব। তার সঙ্গে যদি কিছু হাতে লেখা শেখার বই বা খাতা দেয়া হয় তাহলে লেখাপড়া আরও সুন্দর হবে। তিনি বলেন, অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তলেখার ওপর কর্মশালা করেছি। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। তখনই উপলব্ধি করতে পারলাম যে শিক্ষার্থীদের শেখার খুবই আগ্রহ আছে। কিন্তু শিখানোর কোন উদ্যোগ নেই, আয়োজনও নেই। যাও আয়োজন হয় তা অত্যন্ত নগণ্য। সবাইকে শিখতে হয় ও শেখাতে হয়। অনুপ কুমার দাস বলেন, দেশে অনেক দিবস পালন করা হয় তবে হস্তলেখা দিবস কেন নয়? আমার মতে, আমাদের দেশে হস্তলেখা দিবস পালন করা উচিত। কেননা, সুন্দর হস্তলেখা মানুষের সম্পদ। যার প্রতিনিয়ত চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। যেটা আমাদের দেশে সঠিকভাবে হচ্ছে না। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকদের হাতের লেখা সুন্দর না। ডাক্তারদের অবস্থা আরও খারাপ। তারা কি লিখেন তা বুঝারও উপায় নেই। যার ফলে তাদের প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারে না। বর্তমানে অনুপ কুমার দাস নারায়ণগঞ্জ নগরীর হেরিটেজ স্কুলের ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অবৈতনিকভাবে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জের শীর্ষে থাকা একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুন্দর হাতের লেখার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সুন্দর হাতের লেখার প্রয়োজনীয়তার বার্তাও পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। এতে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন তিনি। অনুপ কুমার বলেন, হাতের লেখা হচ্ছে বড় মানবসম্পদ, একে সংরক্ষণ আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। শিক্ষা চাই সবার আগে। শিক্ষা চাই ঘরে ঘরে। হাতের লেখা শুধু আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা যেন খারাপ না হয় সেজন্য হাতের লেখা সুন্দর করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। কম্পিউটার যতই কাজ করুক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু হাতে লেখেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এর কোন বিকল্প নেই। সুন্দর হাতের লেখা শেখা এমন কিছু কঠিন নয়। পড়া কিন্তু প্রতি বছর বাড়বে, লেখা বাড়বে না। প্রতিদিন ত্রিশ মিনিট করে নব্বই দিন অভ্যাস করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজী সুন্দর মুখস্ত করতে পারলে হাতের লেখা কেন সুন্দর হবে না। অনুপ কুমার সুন্দর হাতের লেখা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। হাতের লেখাই তার ধ্যান-জ্ঞান। কিছু বেসিক পদ্ধতি (স্টোক) আছে এ গুলো প্রথমে শিখতে পারলে হাতের রেখা সুন্দর হবেই। এই পদ্ধতিগুলো (স্টোকগুলো) প্রথমে আমাদের আগ্রহ নিয়ে শিখতে হবে। প্রদ্ধতিগুলো (স্টোকগুলো) শিখতে না পারলে হাতের লেখা সুন্দর হবে না। লেখা সুন্দর করার কিছু নিয়ম-কানুন আছে। যেমন কিভাবে কলমটি ধরতে হবে, খাতাটি কিভাবে সামনে রাখতে হবে, কি করে সঠিকভাবে বসতে হবে ইত্যাদি। অনুপ কুমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যালিওগ্রাফার হিসেবে তৈরি করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এ জন্য সরকার থেকে শুধু সহায়তা চাচ্ছেন। অনুপ কুমার বলেন, শিক্ষা বিস্তার ও প্রসারের জন্য সরকার নানামুখী অবস্থান থেকে শিক্ষাকে যেভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেটা খুবই প্রশংসিত। আশা করি সুন্দর হাতের লেখার ওপরও এ ব্যাপারে সরকারও সু-নজর দিবেন। একদিন সুন্দর লেখার ওপর বাংলাদেশে হস্তলেখা বিপ্লব হবে। সুন্দর হবে এদেশের লেখাপড়ার মান। শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতির জন্য সুন্দর হাতের লেখা খুবই প্রয়োজন। অনুপ কুমার দাস আজীবন সুন্দর হাতের লেখার কৌশল শিখিয়ে যেতে চান। এটাই তার স্বপ্ন।
×