পর্ব-৩৯
’৭৩ এ দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটকাভিনয় শুরু হবার পর থেকে নাটক নিঃসন্দেহে অগ্রসরমান। কী নাটক নির্বাচনে, কী অভিনয়ে, কী সেট-আলো ইত্যাদি অনুষঙ্গের ব্যবহারে। এখানে আমি পেশাদারিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই। কেননা, ‘পেশা’ নামক দ্বি-আক্ষরিক শব্দটি নাটকের সঙ্গে তার জড়িত থাকার বিষয়টি জানান দিয়েছে অনেক আগেই। মানুষ যে কাজ করতে ভালোবাসে সে কাজ করেই যদি তার জীবনধারণ করা সম্ভব হয়, এর চেয়ে সুখপ্রদ এবং কাম্য আর কিছু হতে পারে না। প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, স্বনামধন্য বাংলাদেশি আলোকচিত্রী ডক্টর শহীদুল আলম যখন বিলেত থেকে রসায়নশাস্ত্রে পি.এইচ.ডি করে দেশে ফিরে এলেন, তার কিছুদিন পরে আমার সঙ্গে কোন এক আনন্দসন্ধ্যায় তাঁর প্রথমবারের মতো আলাপ হয়। ততদিনে তিনি ফটোগ্রাফার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং আমি ওই পরিচয়টিই জানতাম। সেই সন্ধ্যাতেই জানলাম যে তিনি রসায়নশাস্ত্রেরও প-িত। কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার পেশা কী?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন, ছবি তোলা।’ আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘কেন, কেমিস্ট্রি নয় কেন?’ উনি বলেছিলেন, ‘একটা ডিগ্রী নেবার দরকার ছিল, নিয়েছি। যে বিষয়টিকে আমি আমার প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, তাহলো ফটোগ্রাফি। আমি ভাগ্যবান। ছবি তুলেই আমার সমস্ত জাগতিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।’
এমন ভাগ্যবান শিল্পী ক’জন আছেন? বিশেষ করে এই বাংলাদেশে? শুধু বাংলাদেশ কেন পাশ্চাত্বের ধনী দেশ আমেরিকাতেও অধিকাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয়ের পাশাপাশি অন্য পেশা বা বৃত্তির ব্যবস্থা রাখেন। অনেক বছর আগে, দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে এসে আমার এক তরুণ বন্ধু আমাকে বলেছিলেন যে, যা হবার হবে, তিনি অভিনয়কেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন। শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এঁদের একজন সফল হলে আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবে অভিনয়কে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করতে। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, তিনি বেশ কিছুদিন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি। এতো গেল শিল্পকর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার প্রসঙ্গ। এই পেশাকেন্দ্রিক আরও একটি ব্যাপার আছে যা আমার মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন নিশ্চিতভাবে জানতাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারলেই একটি ভদ্রগোছের চাকরি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কজেই, আমরা যখন নাটক শুরু করি তখন আমাদের সাথের বেশিরভাগ তরুণদেরই জীবিকা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। সারাদিন পেশার কাজে ব্যস্ত থাকার পর সন্ধ্যায় নাটক। এই ছিল রুটিন। আজকের তরুণদের অবস্থা ঠিক এক নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্ব বেড়েছে। এখনকার তরুণেরা পাশ করে বেরিয়ে কী করবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত নন। সর্বদাই জীবিকার চিন্তায় তারা দিশেহারা। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে তাদের কাছ থেকে সেরকম একাগ্রতা এবং অভিনিবেশ আশা করা যায় না। তবে এরপরেও কথা থেকে যায়। তিয়াত্তরে নাটক শুরু হবার পর গত ছেচল্লিশ বছরে মঞ্চনাটকের জোয়ার বয়ে গেছে বাংলাদেশে। সেই তখন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত জোয়ারের বেগ সমানভাবে চলে আসছে। এই জোয়ারের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এমন অনেক তরুণ নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ করেছেন যাদের উপস্থিতি নাটকের জন্য আদৌ কোন মঙ্গল বয়ে আনেনি। বরং নাটককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এদের অনেকেরই ধারণা কোনোমতে একটি নাটকের গ্রুপে ঢুকে পড়তে পারলেই বাঘা-বাঘা সব চরিত্রে অভিনয় করবার সুযোগ পাওয়া যাবে, কেননা অভিনয় কে না পারে? এবং পরবর্তীতে গ্রুপের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আরও বর্ণময় ঐন্দ্রজালিক যে মাধ্যম, টেলিভিশন -তাতে চেহারা দেখানো যাবে। আর একবার যদি টেলিভিশনে চেহারা দেখানো যায়, তাহলে তো বাজিমাৎ! অন্যদিকে, আজকে বহু টিভি চ্যানেল হওয়ায় সুবাদে অনেক তরুণ অভিনেতাই অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। কিন্তু অভিনয়ের মান বজায় রেখে, সফলতার সঙ্গে দীর্ঘদিন এ পেশায় নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন ক’জন অভিনেতা?
মঞ্চনাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অর্থ হচ্ছে নাটকে হাতে-কলমে কাজ করা। নাটক নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। মহিলা সমিতি কী জাতীয় নাট্যশালার সামনে ভিড় করে বসে পরচর্চা বা অর্থহীনভাবে ভরা ভাষায় চায়ের কাপে তুফান তোলা নয়। তরুণ নাট্যজনদের নাটকে ব্রতী হতে হলে কতগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ সিদ্ধান্তগুলোর প্রথমটিই হলো সবচেয়ে শক্ত। তাঁর নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আমি কেন নাটক করব? মুখ দেখানোর জন্যে? নাকি একটা শিল্পকর্মের শিল্পসম্মত চর্চা করার জন্যে? কেননা, অভিনিবেশ সহকারে চর্চা করলে, পরিচিতি-জনপ্রিয়তা এবং আত্মতৃপ্তি -এসবই সময়ে আয়ত্ত করা যাবে। সেক্ষেত্রে শিল্পকর্মের চর্চায় তাদেরকে কতগুলো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পেশা বা পড়াশোনার বাইরে যতখানি সময় সম্ভব নাটককে দেওয়া। মঞ্চনাটকের শিডিউল থাকলে সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য বিষয়ে সময় দেবে।
অতএব, আমার তরুণ নাট্যবন্ধুদের প্রতি আমার পরামর্শ হবে এই যে, সর্বপ্রথম শিল্পকর্ম হিসেবে নাটকের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য সৃষ্টির মধ্যেই বোধহয় নিহিত আছে আগামী দিনের নাটকের বলিষ্ঠ পদচারণা। নয়তো আমরা পথ হারিয়ে ফেলব।
শীর্ষ সংবাদ: