ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

বিজ্ঞাপনের ইতিহাস ॥ উপমহাদেশের পত্রপত্রিকায়

প্রকাশিত: ১২:১৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বিজ্ঞাপনের ইতিহাস ॥ উপমহাদেশের পত্রপত্রিকায়

গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথই (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) শুধু নয় পৃথিবীর অনেক দৃশ্য এবং অনেক বস্তুই অহরহ আমাদের মন ভোলায়। তার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন প্রচারের সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যম বোধকরি সংবাদপত্র। তারপর এসেছে বেতার এবং সবশেষে টেলিভিশন। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে প্রাচীন বা আদিযুগের সংবাদ পত্রের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞাপন। তাই, সেকালে অনেক নামী-দামী সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার প্রায় পুরোটাই জুড়ে থাকত বিজ্ঞাপন। বাংলার প্রাচীন পত্রিকার ক্ষেত্রেও দেখা যায় ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকরের’ (১৮৪০ খ্রি.) প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন শিরোনাম যুক্ত দুটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার প্রথম যুগের সাময়িক পত্র রংপুর দিক প্রকাশ (১৮৬০ খ্রিঃ) পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রায় পুরোটাই জুড়ে ছিল বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন যেহেতু আয়ের অন্যতম উৎস সে কারণে সংবাদপত্রের প্রচলনের শুরু থেকেই বিজ্ঞাপনের বেতার বা টেলিভিশনেও বিজ্ঞাপনের অনুপ্রবেশ ঘটে। সে কালের নামী-দামী কবি- সাহিত্যিকরাও বিজ্ঞাপন প্রচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং একদা এক বিশিষ্ট কালো কালির প্রশংসা করে লিখেছিলেন এর কালিমা বিদেশী কালির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিখিত প্রশংসাপত্রটি ব্লক করে বিজ্ঞাপন রূপে বহুল প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ জীবিতকালে বিজ্ঞাপনে নানা ভাবে হাজির হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় মৃত্যুর পরও তাঁর ভাষ্য, বাণী, প্রতিকৃতি, হস্তাক্ষর, স্বাক্ষর ব্যবহার হয়েছে নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনে। এসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দ বাজার, বসুমতী, শনিবারের চিঠি, বিশ্ব ভারতীসহ নানা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রে। বলা হয় তিনি বিজ্ঞাপনের মডেল হতে রাজি হয়েছিলেন মূলত স্বদেশী আন্দোলনের যুগে স্বদেশী পণ্য বস্তু প্রসারের জন্য। দি ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটের ১৯৪১ সালের অমল হোম সম্পাদিত ‘ঞবমড়ৎব সবসড়ৎরধষ’ সংখ্যায় ডোয়ার্কিন কোম্পানি বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ৭ আশ্বিন সংখ্যার প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ ঘোষকে একটি চিঠি ছাপে ‘মহাশয়েষু/আপনাদের ডোয়ার্কিন ফ্লুট পরীক্ষা করিয়া বিশেষ সন্তুষ লাভ করিয়াছি, ইহার ছাপার অতি সহজেই চালান যায়- ইহার সুর প্রবল ও সুমষ্টি। ইহাতে অল্পের মধ্যে সকল প্রকার সুবিধাই আছে। দেশীয় সঙ্গীতের পক্ষে আপনাদের এই যন্ত্র যে বিশেষ উপযোগী তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি এই যন্ত্র ক্রয় করিতে ইচ্ছা করি। আমাকে ইহার মূল্য লিখিয়া পাঠাইবেন (শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।’ বিজ্ঞাপনটি রবীন্দ্র্রনাথের মৃত্যুর ৫৩ বছর পরে চিঠিসহ প্রকাশিত হয়। হেমেন্দ্রনাথ বসু বিখ্যাত কুন্তলীন কেশ তেলে রবীন্দ্র প্রতিকৃতির নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরসহ লেখা থাকত- ‘কুন্তলীন তৈল আমরা ২ মাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুর উঠিয়া যাইতেছিল ‘কুন্তলীন’ ব্যবহার করিয়া ১ মাসের মধ্যে তাঁহার নতুন কেশোদাম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুগন্ধে পরিণত হয় না। স্বাক্ষর : শ্রী রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশ্বিন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ। আরও কত বিচিত্রভাবে যে, রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে পারি। সেকালে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রে তিনি মডেল হয়েছেন। যেমন- দীপালী পত্রিকার ১ম বর্ষ ২৪ সংখ্যায় (১৯ জুন ১৯৩৭ খ্রি.), বোর্নভিটা কোম্পানির পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে ‘বোর্নভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি’ লেখা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া কেশ তেল, সুরভী ক্রিম, কাজল কালি, উন্মাদ রোগের ওষুধ, লিপটন চা, ফিলিপস্ রেডিও, মার্টিন বান, রেল দফতর প্রভৃতি বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। প্রথম দিকে চায়ের বিজ্ঞাপনে তিনি যে রচনাটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন সেটি হলো- হায় হায় হায় দিন চলে যায়।. চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতল দল চল, টগবগ উচ্ছল কাথলি তল-জল এল চীন গগণ হতে পূর্ব পবন ¯্রােতে শ্যামল রস ধর পুঞ্জ॥. শ্রাবণ বাসরে রস ঝর’ ঝর’ ঝরে পূর্ব পবন ¯্রােতে ভূঞ্জ হে ভূঞ্জ দলবলহে।. চল’ চল’ হে ॥ কল’ কল’ হে।. বিখ্যাত একজন কবি সে’কালে চাতক তুল্য চা-রসিক সবাইকে চা-পানে আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন- ‘চায়ের পেয়ালা যদি সাগর হতো, সাতার কাটিতাম আমি মনের মতো।’ বিদ্রোহী কবি নজরুলও সেকালেও বিজ্ঞাপনমূলক কিছু কিছু কবিতা লিখেছিলেন। ‘ডোয়ার কিন এ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির হারমোনিয়ামের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন ‘কি চান? ভাল হারমোনি? কাজ কি গিয়ে-জার্মানি? আসুন দেখুন এই খানে সেই সুরে আর সেই গানে, গান না কেন, দিব্যি তাই, মিলবে আসুন এই হেথাই? কিনবি কিন “ডোয়ার কিন”। “বাহাদুর কোম্পানি“র সেকালের এক বিজ্ঞাপনে নজরুল লিখেছিলেন-“মিষ্টি “বাহা বাহা ” সুর, চান তো কিনুন বাহাদুর” দু’দিন পরে বলবে না কেউ “দুর দুর”। ১৮৯৬ সালে জনৈক হেমেন্দ্র মোহন বসু তাঁর প্রস্তুত পণ্যদ্রব্য “কুন্তলীন কেশ তেল”-এর নামানুসারে এক সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এটি ছিল ছোট গল্প রচনার প্রতিযোগিত। বার্ষিক এই প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কর্মফল’ গল্পটি লিখে পাঠান। ছদ্মনামে পাঠানো শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প ‘মন্দির’ কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। হেমেন্দ্র মোহন বসু প্রতিবছর প্রতিযোগিতার জন্য প্রাপ্ত গল্পগুলো সঙ্কলন কবে সেকালে ‘কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কার’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপন রচনায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচিত এমনি একটি বিজ্ঞাপন- “কেশে মাখো কুন্তলীন অঙ্গবাসে দেলখোস, পানে খাও তাম্বলীন ধন্য হোক এইচ বোস।” পরবর্তীকালে অনেক পুরস্কারের সঙ্গে, সে সাহিত্য পুরস্কারই হোক বা অন্য কোনো বিষয়ই হোক, বিজ্ঞাপন পণ্যের নাম সংযুক্ত হতে দেখা যায়। আমাদের দেশে সাময়িক পত্রের বিজ্ঞাপনে রমনীর চিত্র ব্যবহারের আদি ইতিহাস আমার জানা নেই। তবে ১৯৩৪ সালের ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকার একটি প্রসাধন দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে অভিনেত্রী ‘সাধনা বসু’র প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটি ছিল ‘ওয়াটিন ক্রিমের’ একটি মুখে মাখা ক্রিম। তখন মডেলিংয়ের বিশেষ প্রচলন না হওয়ায় বিজ্ঞাপনের সাধারণ অভিনেত্রীদেরই আলোক চিত্র শোভা পেত। প্রযুক্তি অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনে ও দেখা গেল বিরাট পরিবর্তন। শুরু হলো রঙিন চিত্র প্রযুক্তির যুগ। তাই বিজ্ঞাপনের পণ্য ছাপিয়ে প্রাধান্য হয়ে উঠল রঙিন চিত্রের বাহার, আর মডেলিংয়ের বদৌলতে নানা রমণীর সুদৃশ্য চিত্রের জৌলুস। একালে আলোক চিত্র শিল্পী এবং চিত্রকর সম্মিলিতভাবে বিজ্ঞাপনকে সুশোভিত ও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। আবার কোন কোন বিজ্ঞাপন আছে যা বাধ্যতামূলক । যেমন পাসপোর্ট বা পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেলে ডুপ্লিকেট ইস্যু করার জন্য খবরের কাগজে অবশ্যই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হয়। বিজ্ঞাপনে বলতে হয় আমার অমুক নম্বর পাসপোর্ট অথবা অমুক পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন দাতা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের যে শুধু আকৃষ্ট করেন তা নয়, মাঝে মধ্যে তার পণ্যক্রয়ে প্রলুব্ধও করে থাকেন এবং ক্রেতাকে ‘ফাও’ কিছু দেয়ার রেওয়াজ প্রয়োগ করে থাকেন। বিজ্ঞাপনের শিল্পরসে অনেক সময় চমক থাকে। অনেক সময় সুকৌশলে সাসপেন্স সৃষ্টি করা হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলো ৩ শ্রেণির ভাগ করা যায়- (১) দেশীয় (২) সম্পূর্ণ বিদেশি (৩) বিদেশীয়, কিন্তু ভাষান্তরিত। কোন কোন বিজ্ঞাপন আমাদের ভাষা জ্ঞান বা বিবেক ও অনুভূতিকে বিপন্ন করে তোলে, বহুদিন আগে কোন এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় এক কিশোরী বিশেষ পণ্যের কৌটাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে তা মুখে দিয়ে চুষতে শুরু করল। আর একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, এক প্রণয়াকাক্সক্সক্ষী তরুণী তাঁর প্রিয়জনকে অভিমানের সুুরে বলে- ‘আমারে পছন্দ না হলেও আমার চা-রে পছন্দ হবে।’ আরেকটি বিজ্ঞাপনে শুনতে পাই, বিজ্ঞাপনের স্লোগান ‘চা’ তো পছন্দ হবেই, কারণ চায়ে রয়েছে ...বিজ্ঞাপনটি দেখে আমাদের দুঃখ বোধহয় কারণ একটি রমণী হৃদয়ের আর্তি এখানে ভেসে গেলো স্লোগানের নিষ্ঠুর মন্তব্যে। তা ছাড়া বিজ্ঞাপনে আর একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সেরা শ্রেষ্ঠ এবং উৎকৃষ্ট এ জাতীয় বিশেষণ যে হারে সব পণ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে তাতে কোন পণ্যটি সেরা ও কোন্টি সেরা নয়, তা নির্ণয় করার দুরূহ কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আমরা অবলিলাক্রমে বলতে পারি সব পণ্যই যদি সেরা হয়, তা হলে যে কোন একটি পণ্য কিনলেই তো আমাদের চলে এ নিয়ে আর কোন ভাল-মন্দ নেই।
×