ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শহরের সুবিধা পেলে শিল্পায়ন সম্ভব

বিদ্যুতের মানসম্মত বিতরণ ব্যবস্থা গ্রামে গড়ে ওঠেনি

প্রকাশিত: ১১:১৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বিদ্যুতের মানসম্মত বিতরণ ব্যবস্থা গ্রামে গড়ে ওঠেনি

রশিদ মামুন ॥ গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের মানসম্মত বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। মোট বিদ্যুত গ্রাহকের মধ্যে ৭৬ ভাগই গ্রামীণ এলাকার। দ্রুত গ্রামে বিদ্যুতের সম্প্রসারণ হলেও সময়ে উপযোগী সেবা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সরকার চলতি বছরের বাজেটে প্রতিটি গ্রামে শহরের সমান সুবিধা পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু গ্রামে শহরের সমান সুবিধা পৌঁছে দিতে সবার আগে গ্রামগুলোতে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে গ্রামে শিল্পায়ন হবে, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। যাতে গ্রাম ছেড়ে মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমে আসে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এজন্য পল্লী অঞ্চলের বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আরইবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে আরইবিতে ব্যাপক কারিগরি পরিবর্তন দরকার। এজন্য আরইবি বছরের শুরুর দিতে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সম্ভাব্যতা জরিপ শুরু করেছে। যা শেষ হবে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ। সেখানেই উঠে আসবে গ্রামীণ বিদ্যুত ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ সম্পর্কে বলেন, আমাদের দেশে যেভাবে ঝড় হয় সেখানে ভূগর্ভস্থ লাইন নির্মাণ ছাড়া কোনভাবে মানসম্মত বিদ্যুত দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া আমাদের সাবস্টেশনগুলোও আন্তর্জাতিক মানের নয়। তিনি মনে করেন এসব বিষয়ে এখন নজর দেয়া উচিত। সূত্র বলছে আরইবিতে এখন মোট সাবেস্টশন রয়েছে এক হাজার ১০০টি। এরমধ্যে ৬৪০টি স্বয়ংক্রিয়। সেখানে কোন মানুষ থাকে না। বিতরণ লাইনে পরপর তিনবার ত্রুটি দেখা দিলে সাবস্টেশনটি আপনা থেকে সারিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তিনবারের পর আর পারে না। সেক্ষেত্রে সাবস্টেশনটি সংশ্লিষ্ট পল্লী বিদ্যুত সমিতির জিএমের অফিসে বার্তা দেয়। তখন এসে সাবস্টেশনটি সারিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ শুরু করতে হয়। সাধারণত অল্প চাহিদার গ্রাহকদের এসব সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুত দেয়া হয়। আরইবির ৪৬০টিতে মানুষ থাকে। ত্রুটি হলে সঙ্গে সঙ্গে সারানো সম্ভব। আরইবির প্রত্যেকটি বিতরণ লাইনের দৈর্ঘ্য অনেক বেশি। বিতরণ লাইনে আধুনিক পদ্ধতিতে ত্রুটি শনাক্ত করার কোন পদ্ধতি নেই। এখন কোথাও ত্রুটি দেখা দিলে ম্যানুয়ালি ত্রুটি খোঁজা হয়। ফলে ত্রুটি দেখা দিলে খুঁজে পেতেই অনেক সময় লেগে যায়। সারানোত আরও পরের বিষয়। মূলত সময়ে সময়ে লাইনে ত্রুটি আর সাবস্টেশন বিকল হয়ে যাওয়াতে মানসম্মত বিদ্যুত পায় না গ্রামের মানুষ। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, মানসম্মত বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য কাজ করা হচ্ছে। বেশকিছু বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পর কাজ শেষ হলে মানসম্মত বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত হবে। আরইবির এক কর্মকর্তা বলেন, এখন একটি মাস্টার প্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই মহাপরিকল্পায় শুধু ভোক্তাই চিহ্নিত করা হবে না একই সঙ্গে ভোক্তার সমস্যা সমাধানে কার্যকর পন্থা অনুসরণ করা হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রভাব নিরুপণ করা হবে। যা সব থেকে জরুরী বলে মনে করেন তিনি। ওই কর্মকর্তা জানান, আগামী বছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ এই মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করার কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, এছাড়াও পল্লী বিদ্যুত সমিতিগুলোর বিতরণ ব্যবস্থা আরও সুসংহত করার জন্য পৃথক আরেকটি সম্ভাব্যতা জরিপ চালানো হচ্ছে। এই জরিপে উঠে আসবে কিভাবে বিতরণ নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করলে গ্রাহক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পাবেন। এটির কাজ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা শুরুতেই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। শহর এবং গ্রামকে কেন্দ্র করে এই প্রযুক্তিগত বিভাজন করা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন গ্রামীণ পরিবেশের জন্য উপযুক্ত করে বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে বলেই এর নাম দেয়া হয় পল্লী বিদ্যুত। শুরুর দিকে বিদ্যুত থাকাটাই একটি বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখত সাধারণ মানুষ। সেই বিদ্যুত সারাদিন কতটা সময় ধরে রইল আর কত বার এলো আর গেল তা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না কারও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সঙ্গত কারণে এখন বিদ্যুতহীনতা ভাবাচ্ছে তাদের। অন্যদিকে বিতরণ ব্যবস্থার এই দুর্বলতার কারণে গ্রামীণ জনপদে শিল্পায়ন হয়নি। ভারি শিল্প তো দূরের কথা ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পও আশানুরূপ বিকশিত হয়নি। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ যেখানে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছে। মোট ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুত উৎপাদর করা যখন সম্ভবই হচ্ছে না তখন মানসম্মত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলাকে জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে। আরইবির ব্যাপ্তি হিসেব করলে দেখা যায় সারাদেশে আরইবির আওতাধীন গ্রামের সংখ্যা ৭৯ হাজার ৯০৭টি। গ্রামগুলোতে বাড়ি রয়েছে ২ কোটি ৫১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৭৩টি। অন্যদিকে আরইবির অধীনে মোট জনসংখ্যা ১০ কোটি ৬৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬৭৩ জন। এর বিপরীতে আরইবি তাদের প্রকাশিত তথ্যে বলছে সারাদেশে তাদের ক্ষুদ্র শিল্পে সংযোগ রয়েছে এক লাখ ৬২ হাজার ৪৭১টি। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৫৫৮ জনের বিপরীতে একটি ক্ষুদ্র শিল্প সংযোগ। অন্যদিকে বৃহৎ শিল্পের বেলায় সংযোগের অবস্থা আরও করুন। আরইবি বলছে তাদের মোট শিল্প সংযোগের সংখ্যা ১২ হাজার ৩০৭টি। মোট অধিভুক্ত জনসংখ্যার হিসেব দিয়ে ভাগ করলে দেখা যায় ৮ হাজার ৬৮৫ জনের বিপরীতে একটি শিল্প সংযোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন শিল্পে বিদ্যুতায়নে অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের যে নিশ্চয়তা দিয়েছে তা এখন নিশ্চিত করতে পারেনি আরইবি। অন্যদিকে আরইবি বলছে এখন তাদের আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা দুই কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার ৫৯১টি। আর সব মিলিয়ে আরইবিতে গ্রাহক সংখ্যা দুই কোটি ৬৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪১৫টি। অন্যদিকে সারাদেশে মোট বিদ্যুত গ্রাহকের সংখ্যা তিন কোটি ৪৮ লাখ। অর্থাৎ অন্য চারটি কোম্পানি এবং পিডিবি মিলে ৮৩ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুত বিতরণ করে। দেশের মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ৫৫ ভাগ একই বিতরণ করছে আরইবি। টাকার অঙ্কে আরইবি প্রতিমাসে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার বিদ্যুত বিক্রি করছে। আরইবির তথ্য অনুযায়ী ৯৯ দশমিক ২৯ ভাগ বিলই আদায় হচ্ছে। অর্থাৎ বিদ্যুতের বিক্রি এবং আদায় দুটোই সন্তোষজনক। কিন্তু এরপরও কেন সেবা প্রদান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আরইবির এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের প্রত্যেক গ্রামে শহরে সুবিধা সম্প্রসারণের ঘোষণা দেয়ার পর শিল্প সংযোগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এজন্য ৫০ কিলোওয়াট পর্যন্ত ট্রান্সফরমার শিল্প গ্রাহকে ফ্রি দেয়া হচ্ছে। এর আগে গ্রাহককে নিজের টাকায় ট্রান্সফরমার কিনতে হতো। এছাড়া শিল্প গ্রাহকে নিজস্ব অর্থে যাতে লাইন নির্মাণ করতে না হয় সে জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পটি শুরু হলে শিল্প গ্রাহকের আঙ্গিনা পর্যন্ত ফ্রি লাইন নির্মাণ করে দেয়া হবে। অন্য বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিতে শিল্প গ্রাহককে ট্রান্সফরমার কিংবা সাবস্টেশন এবং বিতরণ লাইন নিজস্ব খরচে নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু সবকিছু ফ্রি দেয়ার পরও গ্রাহক কী নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাবে, সেই প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর দিতে পারছে না আরইবি। যাতে শিল্প উদ্যোক্তাদেরও আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামে শহরের সুবিধা সম্প্রসারণ করতে চাইলে সম্প্রসারণের দিকেই নজর দিলে হবে না, মানসম্মত বিদ্যুত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে আরইবির ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে আরইবির সরবরাহ ব্যবস্থা অনেকটা ঋতু বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে। গ্রীষ্মে অতি গরমের কারণে চাহিদা বেড়ে গেলে লোডশেডিং হওয়াটা স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে গিয়েছে গ্রামের মানুষ। অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টির সময় আকাশে মেঘ হলেই বিদ্যুত চলে যাবে এটাও স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয়। তবে ঝড় থেমে গেলে বিদ্যুত কখন আসবে সেই নিশ্চয়তা নেই। তবে শীতের সময় বিদ্যুতের আসা যাওয়ার খেলা থাকলেও অনেকটা সহনীয় থাকে বিতরণ ব্যবস্থা। আরইবির এক কর্মকর্তা জানান, বিতরণ ব্যবস্থার সব থেকে বড় দুর্বলতা হঠাৎ গ্রাহক বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। বিদ্যুতের সব থেকে বেশি সমস্যা আরইবিতে। এজন্য বিতরণ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা জরুরী। যার কাজ শুরু করতে চায় আরইবি। এজন্য একটি সমীক্ষা করার কাজ শুরু হয়েছে যা শেষ হলে বোঝা যাবে আসলে কি কি পদক্ষেপ নিলে আরইবির গ্রাহকরা স্বস্তি পাবে। তিনি বলেন, আরইবিতে অটোমেশন জরুরী, লাইনের কোথায় সমস্যা হলো তা ঘরে বসেই চিহ্নিত করার পদ্ধতি সংযোজন (অটো ফল্ট ডিটেকশন) করা প্রয়োজন। এছাড়াও মানুষবিহীন সাবস্টেশনগুলোকে ধীরে ধীরে মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। যার কাজ শুরু হয়েছে। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, আরইবির সেবা আধুনিকায়ন করতে হলে আরও অটোমেশন দরকার। ব্যাপকভাবে অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে আরইবিকে। যাতে মানুষের বদলে প্রযুক্তিই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তিনি মনে করেন গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের কোন বিকল্প নেই।
×