ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাক বর্ষা

একদিনের বর্ষণকে রেখে বিদায় বৃষ্টির

প্রকাশিত: ১১:০৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

একদিনের বর্ষণকে রেখে বিদায় বৃষ্টির

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাতেন মা। মুখ ধোয়া শেষে একগ্লাস হরলিকস আর সকালের নাস্তা। স্থান করানো। বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। পছন্দের চিপস আর আচার কিনে দেয়া। সব রকমের বায়না পূরণের একমাত্র জায়গা ‘মা’। তিনবেলা গান আর ভূতের গল্প বলে খাওয়ানো। টুকটাক পড়াশোনায় মন বসানোর চেষ্টা। ছোট্ট শিশু বলে কথা। নানা বাহানায় পড়ার টেবিল থেকে ওঠে খেলার ধান্দা। তবুও মায়ের চেষ্টা সন্তানকে অ-আ-এক-দুই-এ-বি-সি-ডি-শেখানোর...। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। আদরের দুলালি। তাই তাকে মা সাজুগুজু করিয়ে দিতেন প্রতিদিন। আলতা, টিপ আর নেইল পলিশ একদিন পরপর দিতেই হবে। অসুস্থ মা। তাতে কি। বায়না পূরণ না করে উপায় নেই। সন্ধ্যায় ছোট্ট সোনামণির চুল বেঁধে দেয়াও ছিল মায়ের নিত্যদিনের কাজেরই অংশ। মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে রাতে ঘুম আসত না তার। এ যেন প্রতিদিনের রুটিন। ১৩-১৭ সেপ্টেম্বর পাঁচদিন হলো ‘মা’ নেই। মায়ের মৃত্যুর দিন সকালে নিজ হাতে যে জামাটি বর্ষাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন ক’দিন ধরে সে জামাটিই গা থেকে নামছেনা তার। বলছে, মা না এলে জামা খুলবেনা সে। নতুন জামাও কেউ তাকে পরাতে পারছেনা। পাঁচ বছরেই শিশুটি মায়ের সব কথাই যেন মনে রেখেছে। মায়ের ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছে এ ঘর ও ঘর। আপনজনদের বলছে মা তো হাসপাতালে ভাইকে আনতে গেল। আর তো এল না...। কোথায় গেল মা...। মাকে এনে দাও। নয়ত মার কাছে আমাকে নিয়ে চল। মার জন্য আমার খুব মন খারাপ। এখন কে আমাকে খেলতে বারণ করবে। কে মুখে খাবার তুলে দেবে। রাতে ঘুম পাড়াবে। খেলনা কিনে দেবে। দুধ খাইতে বলবে। নতুন টাকাও এখন আর কেউ দেয় না। কে বলবে বর্ষা কোন দুষ্টুমি নয়...বাবা এলে কিন্তু মারবে...। মাকে নিয়ে ছোট্ট এই শিশুটির হরেক রকম স্মৃতিচারণ শুনে পরিবারের সবার চোখে জল ঝরছে রাতদিন। কিভাবে- কি বলে সান্ত¡না দেবে তাকে। বলার ভাষা কারও নেই। তাকে বোঝানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন সবাই। মা ছাড়া সে খাবে না। রাতভর জেগে থাকার চেষ্টা...। মা না আসা পর্যন্ত ¯œান না করার বায়না। কিন্তু বর্ষা তো এখনও বোঝে না- মাতো একেবারেই না ফেরার দেশে চলে গেছে। কিন্তু মায়ের অভাব পূরণ করার মতো তো কেউ নেই। মা তো মা-ই। মায়ের অভাব তো পূরণ করার নয়। মায়ের বিকল্প হিসেবেও কারও আদর মেনে নিতে পারছেনা ছোট্ট এই শিশুটি। সবার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রায় সময়। কখনও কাঁদে। বিষণœ মনে একা বসে থাকে বিছানায়। গত শুক্রবার দুপুরে মা বৃষ্টি তার মেয়ে বর্ষার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। ছুটি নেয়ার সময় মায়ের শেষ কথা ছিল- হাসপাতাল থেকে তোমার জন্য একটা ভাই আনতে যাচ্ছি। দ্রুত ভাইকে নিয়ে চলে আসব। তুমি কান্না করো না মা। সেখান থেকে আসার পর তুমি ভাইকে নিয়ে খেলবে। সে হবে তোমার খেলার সাথী। ভাই হবে...। ঘরে আনন্দের বন্যা। তাই মাকে অল্প সময়ের জন্য ছুটি দিয়েছিল বর্ষা। মা আরও বলেছিল, হাসপাতাল থেকে এসে সুস্থ হয়ে মার্কেটে যাবে। সামনে দুর্গা পূজা। জামা কাপড় কিনে দেবে। প্রতিমা দেখাবে। অনুষ্ঠানে নেবে...আর কত কি। পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, ছেলের আশায় দ্বিতীয়বার মা হতে যাচ্ছিলেন বৃষ্টি। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ছয়মাস পর থেকেই বৃষ্টির ঘরজুড়ে আনন্দের বন্যা। আলট্রাসনোগ্রাম করার মধ্য দিয়ে ইচ্ছা পূরণের আভাস মিলে। সংসারে যেন আনন্দ আর আনন্দ। আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফোন করে সুখবরটা দিচ্ছিলেন বৃষ্টি নিজেই। এবার আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। ছেলের জন্মের পর আমার মৃত্যু হলেও কোন আফসোস থাকবেনা...। আবেগে পরিবারের লোকদের কাছে এমন কথাও বলেছিলেন বৃষ্টি। সময় ঘনিয়ে আসছে। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর সব রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মা। নিজ হাতে ছেলের কাঁথা বানানো। ছাদে কাপড় শুকানোর জন্য রশি টানানো, কাপড় রাখার জন্য জিনিসপত্র কেনা সবকিছুই যেন ঠিকঠাক। বহু প্রত্যাশিত সন্তান। তাই জন্মের আগেই মা নাম ঠিক করে গেছেন ‘বর্ষণ’। প্রথম সন্তান বর্ষা। তার নামের সঙ্গে মিল রেখেই বর্ষণ নাম রাখা হয়। বাবার নাম বাদল। মা বৃষ্টি। বোন বর্ষা। আর অনাগত সন্তানের নাম বর্ষণ। এ যেন পরিবার আর প্রকৃতির সঙ্গে অনবদ্য এক ভালবাসার মিল। ডাক্তারের সময় অনুযায়ী ২০ সেপ্টেম্বর ছিল সন্তান জন্মের সম্ভাব্য তারিখ। নবজাতকের বয়স পূর্ণ হওয়ায় পরিবারের আগ্রহেই একটু আগেভাগে সিজারের সিদ্ধান্ত হয়। গত শুক্রবার অন্তঃসত্ত্বা বৃষ্টির সিজার করাতে ময়মনসিংহের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের লোকজন। যাওয়ার আগে বাসার লোকজনের জন্য দিনভর পর্যাপ্ত রান্না করে ফ্রিজে রাখা, সবকিছু গোছানো, নিজের চুলে বেনি করা, পায়ে আলতা, নেইল পলিশ দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে হাসিমুখে যাত্রা। নিজ হাতে হাসপাতালের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছানোর কাজ সেরেছিলেন বৃষ্টি নিজেই। এ যাত্রাই যে তার শেষ যাত্রা ছিল কে জানত! সত্যিই। জানার কথাও নয়। বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে পৃথিবীতে আসে ‘বর্ষণ’। আলোকিত হয় বৃষ্টি আর বাদলের পরিবার। কিছুক্ষণ পরই আসে অশুভ সংবাদ। ডাক্তাররা জানান, শিশুর জন্মের পর থেকেই হতভাগী বৃষ্টি ভাল নেই। তাকে অন্য একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। শনিবার ভোরে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও খিচুনি হওয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। যে সন্তানের জন্য দীর্ঘ সময় পথ চেয়ে বসে ছিলেন অভাগী বৃষ্টি, তাকে এক নজর দেখেও যেতে পারেননি তিনি। বর্ষণকে একবারের জন্য কোলে নেয়ারও সুযোগ হয়নি তার। ছেলে সন্তানের জন্য হৃদয়ে যে হাহাকার আর শূন্যতা ছিল তা পূরণ করার একটু সুযোগও পাননি তিনি। হয়ত ছেলেকে বুকে নেয়ার মধ্য দিয়ে সব কষ্ট দূর হয়ে যেত মায়ের। এর আগেই মহা সর্বনাশ যে ঘটতে চলেছে তা হয়ত টের পেয়েছিলে অভাগী মা। তাই মৃত্যুর সময় জিহ্বায় কামড় পড়েছিল তার। এখন বাদলের পরিবারজুড়ে চলছে শোকের মাতম। কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে আকাশ বাতাস। পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন ঘিরে আছে বাড়ি। শোকাহত পরিবেশ। সবার বুকেই চাপা কান্না। শিশু বর্ষণ আছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা শহরে দাদুর বাড়ি। মামির বুকে দুধে ক্ষুধা না মিটলেও বর্ষণ একবারেরও জন্যও কাঁদে না। মাকে হারানোর যন্ত্রণায় শিশুটিও যেন নির্বাক। কেউ বলছেন, লক্ষ্মী ছেলে। কাউকে কষ্ট দেবে না। তাই হয়ত কাঁদেও না সে। তাকে বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে উভয় পরিবারের মধ্যে। আনা হচ্ছে শিশু ডাক্তার। ফিডারে তোলা দুধ দেয়ার চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে পাঁচদিন বয়স পূর্ণ হয়েছে শিশুটির। বর্ষা ভাইকে ছেড়ে আছে দাদার বাড়ি নেত্রকোনার সদর উপজেলার সহিলপুর গ্রামে। অবুঝ দুই শিশুকে বড় করার যে চ্যালেঞ্জ স্ত্রী বৃষ্টি রেখে গেল, তা মোকাবেলা করা যে কত কঠিন তা হয়ত স্বামী হিসেবে বাদল নিজেই উপলব্ধি করছেন। স্ত্রী হারানোর শোকে বারবার মর্মর করে উঠছে পাঁজর। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বারবার চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছেন তিনি। একদিকে বর্ষণ অন্যদিকে বর্ষা... কোন দিকে যাবেন বাবা। হাজারো কষ্ট, যন্ত্রণা আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে বাদলের সামনের দিনগুলো কাটাতে হবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা।
×