শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন ‘আল্লাহর দলে’র নামে সারাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে কয়েক কোটি টাকার সন্ধানে নেমেছে তদন্তকারী সংস্থা র্যাব। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত জঙ্গী সংগঠনটির প্রধান মতিন মেহেদীকে কারাগার থেকে আদালতে নেয়ার পথে ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্র করেছিল জঙ্গী সংগঠন আল্লাহর দল।
সরকার উৎখাতের জন্য নাশকতার ছক কষে গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছিল এই জঙ্গী সংগঠনটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাব সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে আল্লাহর দলের যুগ্ম অধিনায়ক সিরাজুল ইসলাম শাহবুল মৃধাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছে ব্যাংক একাউন্টে কয়েক কোটি টাকা আছে বলে তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। সিরাজুল ছাড়াও গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন, মনিরুজ্জামান মনির (৪০) এসএম হাফিজুর রহমান সাগর (৪৫) ও শফিউল মোযনাবীন তুরিন (২৭)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩ পেনড্রাইভ, ১২ মোবাইল ফোন, ‘আল্লাহর দল’-এর লিফলেট, দাওয়াতপত্র ও আয়-ব্যয়ের হিসাবের একটি টালি খাতা উদ্ধার করেছে। উদ্ধারকৃত টালি খাতায় পাওয়া তথ্যে এবং জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গী সংগঠনটি সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল বলে তদন্তে তথ্য পেয়েছে র্যাব। বিভিন্ন ব্যাংকে আল্লাহর দলের সদস্যদের নামে একাউন্ট খোলা রয়েছে এবং তাদের একাউন্টের বিপরীতের লাখ লাখ টাকা গচ্ছিত রাখা রয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাব আরও সূত্রে জানা গেছে, আল্লাহর দল ১৯৯৫ সালে জাতীয় সংসদের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুল মতিন মেহেদী ওরফে মুমিনুল ইসলাম ওরফে মহিত মাহবুব ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে মতিনুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও সাদুল্যাহপুর থানা এলাকা থেকে এই সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করা হয়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার সঙ্গে আল্লাহর দলের সংশিষ্টতার তথ্য মেলে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ধানম-ির গ্রীন রোডে সরকারী কোয়ার্টার থেকে র্যাব মতিন মেহেদীকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে মতিন মেহেদী ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি হয়ে টাঙ্গাইল কারাগারে বন্দী রয়েছে। তার অনুসারীরা মতিন মেহেদীকে কারাগার থেকে আদালতে নেয়ার পথে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। মতিন মেহেদীর অনুপস্থিতিতে গ্রেফতার আব্রাহিম আহমেদ হিরো আল্লাহর দলের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় র্যাব অভিযান চালিয়ে আব্রাহিম আহমেদ হিরো (৪৬), আবদুল আজিজ (৫০), শফিকুল ইসলাম সুরুজ (৩৮) ও রশিদুল ইসলামকে (২৮) গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে চলতি মাসের প্রথম দিকে দক্ষিণখান এলাকা থেকে ওই চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া সিরাজুল ইসলাম র্যাবকে জানায়, ১৯৯৫ সালে মতিন মেহেদীর নেতৃত্বে ‘আল্লাহর দল’ নামে জঙ্গী সংগঠনটি গড়ে উঠে এবং ২০১৪ সালে মতিন মেহেদী গোপন নির্দেশে এটি ‘আল্লাহর সরকার’ নামকরণ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সংগঠনের সদস্য হওয়ার পর ‘গ্রাম নায়ক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পাবনা, ঝিনাইদহ, খুলনা, রাজশাহী ও নওগাঁয় দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে যুগ্ম অধিনায়ক পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বর্তমানে একই দায়িত্বে বহাল আছেন সিরাজুল। তিনি জঙ্গী সংগঠনটির মামলা মোকাদ্দমাসহ বিবিধ বিষয়াদীর ওপর তদারকি করেন। জঙ্গী দলের সদস্য মনিরুজ্জামান ১৯৯৭ সালে গাইবান্ধার এক জঙ্গী সদস্যের মাধ্যমে সংগঠনে যোগ দেয়। পরে তিনি গ্রাম নায়কসহ বিভিন্ন পদে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও খুলনায় দায়িত্ব পালন করেন। গ্রেফতারকৃত হাফিজুর রহমান সাগর খুলনার খালিশপুর থানায় ‘আঞ্চলিক নায়ক’ এবং পরে ‘জেলা নায়ক’ পদে দায়িত্ব নিয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তার সহযোগী শফিউল মোযনাবীন তুরিন ২০১০ সালে তার দুই বন্ধুর মাধ্যমে ‘আল্লাহর দলে’ যোগদান করেন। ২০১৭ সালে নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতর ও বাহিনীর অবকাঠামোর আদলে সাংগঠনিকভাবে নিজেদের বিন্যস্ত করার চেষ্টা করছে আল্লাহর দল। সে অনুযায়ী গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বকে সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নেতৃত্বের বিন্যাস অনুযায়ী, বিভাগ পর্যন্ত ‘নায়ক’ উপাধির মাধ্যমে প্রধানদের চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদকে অধিনায়ক, উপ-অধিনায়ক, অতিরিক্ত অধিনায়ক, যুগ্ম অধিনায়ক এবং সর্বোচ্চ পদকে তারকা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। সদস্য সংগ্রহের জন্য ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও রিক্রুটের মাধ্যমে সংগঠনের কাঠামো মজবুত করার পরিকল্পনা করেছে আল্লাহর দল। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে যারা চাকরি বা ব্যবসা করে, তারা তাদের উপার্জিত অর্থ থেকে প্রতিমাসে ২ থেকে ৫ শতাংশ হারে সংগঠনকে যাকাত দিয়ে থাকে। এভাবেই আল্লাহর দলের ফান্ড তৈরি করা হচ্ছে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেছেন, যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সংগঠনটির আর্থিক মূলধনের একটি বড় অংশ নামে-বেনামে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছে। মূলত দেশে নাশকতা সৃষ্টি এবং সরকার উৎখাতের কাজে এগুলো ব্যয় করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তাদের কত সদস্য রয়েছে এবং কি পরিমাণ অর্থ রয়েছে সেটি তদন্ত চলছে। তবে অস্ত্র কেনার যে পরিকল্পনা ছিল তাদেরকে গ্রেফতারের কারণে আপাতত বন্ধ থাকছে।
তাদের মূল লক্ষ্য ছিল অনুকূল পরিবেশে দেশের মধ্যে নাশকতায় লিপ্ত হয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। এছাড়া তাদের নিজেদের কাঠামো অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশন এবং ভ্রান্ত ইসলামী সঙ্গীতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে। পাশাপাশি তারা জঙ্গী তৎপরতা জোরদারের জন্য আর্থিক কাঠামো তৈরি করছিল। আল্লাহর দল ও সংগঠনের গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে র্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান র্যাবের কর্মকর্তা।