ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

রমা চৌধুরী ॥ বীর জননীর সজল স্মরণ

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 রমা চৌধুরী ॥ বীর জননীর  সজল স্মরণ

ক’দিন আগে বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর মৃত্যুদিন পার হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে দু’একট স্মরণ অনুষ্ঠান হলেও আমরা তেমন কোন সাড়া দেখিনি মিডিয়ায়। জাতি ও জীবনযাপনের এই সঙ্কটকালে বড় বেশি প্রয়োজন হলেও আমরা এঁদের মনে রাখি না। কে এই রমা চৌধুরী? তাঁকে চিনতাম দীর্ঘসময় ধরে। আমার শ্বশুরবাড়ির পাশে তাঁর বাড়ি। এমন কি তাঁর নাম ও দীপার মায়ের নাম হুবহু এক। রমা চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম দেখা সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তের বাড়িতে। কটা বই নিয়ে এসেছিলেন। নিতান্ত আটপৌরে এক সাধারণ মহিলা। চোখে জল মুখে দুঃখ আর চেহারায় বেদনা। তখনো তাঁর আসল রূপ ধরতে পারিনি। পরে জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের নামে ফেনা তোলা মানুষরা যাদের পুঁজি করে চলেন ইনি তিনি। একাত্তরে জীবনের সবচেয়ে কঠিন বিষয়ে দানবের মুখোমুখি হয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। আমরা সবাই পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংসতার কথা জানি। যুবকের জান নারীর শরীর আর বাংলাদেশের মাটির ওপর ছিল তাদের যত রাগ। যত লোভ। সে লোভ চরিতার্থ করার জন্য তারা যা পারতো তাই করতো। অসহায় রমা চৌধুরী সে লালসার বর্বর শিকার। তাঁর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবার পাশাপাশি তাঁর জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়ার পর ও তিনি দমে যাননি। জীবন কিছু মানুষকে উজ্জ্বল করার জন্য অনেক কিছু কেড়ে নেয়। ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামী সন্তান হারিয়ে এতিম একা নিঃসঙ্গ হবার পর ও লড়াই করেছেন। সে লড়াইয়ের কিছু রূপ আমি দেখেছি। ভরদুপুরে চট্টগ্রাম শহরে তিনি একা বই নিয়ে ঘুরছেন এমন দৃশ্য আমাদের মনে দাগ কাটলেও কেউ তেমন করে এগিয়ে আসেনি। সবার কেমন একটা তাচ্ছিল্য আর এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। তারপরও তিনি হার মানেননি। শিল্প বা সাহিত্যের মেজাজ কিংবা রস কতটা ছিল সে ভাবনা সমালোচকদের মানায়। এঁর লেখা তো আর সে কারণে না। ইনি লিখতেন তাঁর জীবনের কাহিনী। যে কাহিনী না জানলে আমাদের দেশ ও দেশের জন্ম জানা হবে না। এই যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে গর্ব করি এই দেশের নিহত আহত সন্তানদের নিয়ে নিজেদের মর্যাদা আর ইতিহাসের কথা বলি এর আরেক পাশে আছে বীরাঙ্গনাদের করুণ জীবন কাহিনী। একমাত্র জাতির পিতা বুঝেছিলেন তাঁদের ব্যথা। তাও তিনি দেশ স্বাধীনের পর নিজে বলেছিলেন তাঁদের পরিচয় দিতে না চাইলে পিতার নামের পাশে আমার নাম লেখে দাও। ঠিকানা দাও আমার বাড়ির। তিনি চলে যাবার পর দানবের ছায়ায় চলা দেশে কেউ তাদের মনে রাখেনি। এমনও হয়েছিল অনেকে তাঁদের দেখলেও সরে যেতেন। যেন এ এক লজ্জার বিষয়। বহু অনুষ্ঠানে তাঁকে নীরবে প্যানে বসে থাকতে দেখেছি। দেখেছি কিছু বলার জন্য তাঁর আকুলতা। কে তাঁকে বলতে দেবে? স্বার্থপর সমাজ আর সুবিধাভোগী মানুষের দেশে রমা চৌধুরী বরাবরই অবহেলিত। শেষ বিচার তো মানুষের হাতে সবটা থাকে না। সেখানে সময় প্রকৃতি আর কৃতকর্মের গৌরব ও কিছু ভূমিকা রাখে। একসময় তিনি উঠে আসলেন। আমি বলব স্বাধীনতার পরের দুই তিন প্রজন্ম ক্রমেই যখন সচেতন আর ইতিহাস নির্ভর হতে চাইছিল তখনই তিনি উঠে আসেন। মুন্নী সাহার এক টিভি প্রতিবেদনের পর রাতারাতি পাদপ্রদীপের আলোয় এলেও যে সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হতো তা তিনি পেতেন না। যার কেউ নেই তার জন্য প্রকৃতি কোথায় কি রাখে বলা মুশকিল। আলাউদ্দীন খোকন নামে এক যুবক তাঁর পালিত পুত্র হয়ে যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা আমরা কেউই পালন করিনি। একের পর এক বই বের করায় তাঁর অবদান যেমনি লেখা থাকবে তেমনি আমরা এও ভুলব না অনেক বড় বড় মানুষ অনেক নেতা অনেক আওয়ামী লীগার মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও বাস্তবে এমন অসহায় মহিলাকেও ঠকিয়ে গেছেন। এই আমাদের মহানুভবতা। কিন্তু সময়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা রমা চৌধুরী একসময় শেখ হাসিনার কাছ থেকে ডাক পেয়েছিলেন। সে ছবি যাঁরা দেখেছেন নিশ্চয়ই মনে আছে তাঁর সেই বেদনামাখা কান্নামাখা আনন্দের কথা। কি চাইবেন তিনি? সময় ও ইতিহাস যাঁর কাছ থেকে জীবনের পরম সম্পদ কেড়ে নিয়েছিল তাঁকে আমরা আসলে কি দিতে পারতাম? শেষবার দেখা হয়েছিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে। এক অনুষ্ঠানে আমি কথা বলা শেষ করে নেমে দেখি সেই করুণমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে থাকা তাঁর বই দিয়ে বললেন, আমি এসেছি শুনেই দেখা করতে এসেছেন। তারপর অঝোর চোখের জল। সে কবে প্রথম দেখেছিলাম। বীরাঙ্গনা আমি বলি না বলি জননী সাহসিকা। সন্তানদের হারিয়ে দারিদ্র্যতায় ডুবেও হাল ছাড়েননি। বরং স্বয়ং শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন আপন যোগ্যতায়। এক বয়স থেকে খালি পায়ে চষে বেড়ানো এই জননী মাও মাটিকে এভাবেই আপন করে নিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় অবহেলা আর করুণা করা বা এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিবৃত্তি এখন শোকের মাতম বইয়ে দেবে। আপনি না হলে আপনারা না হলে আজ যাঁরা পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে চলেন আজ যাঁরা বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে আগ্রহী তাদের কারই সুযোগ হতো না এমন করার। এই দেশ এই মাটি একাত্তরে আপনার পুনরক্তে ভেসেছিল। আজ আপনার শরীর যখন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তখন তার ভেতর থেকেই আপনার আত্মা বেরিয়ে মিসে যাবে এদেশের হাওয়ায় হাওয়ায়। আপনারাই আমাদের শেষ গর্বের ইতিহাস। [email protected]
×