ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজও কি আফিফের দিন?

প্রকাশিত: ১২:০০, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আজও কি আফিফের দিন?

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ওয়ানডে বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচ হেরে মিশন শেষ করা দলটি শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েও টানা তিন ম্যাচ হারে। এরপর ঘরের মাটিতে একমাত্র টেস্টে নবীন দল আফগানিস্তানের কাছেও হেরে যায়। টানা ৬ হারের তিক্ততা ভুলে ত্রিদেশীয় টি২০ সিরিজে জয়ে ফেরার প্রত্যাশায় নামে বাংলাদেশ দল। কিন্তু সেই ম্যাচেও পরাজয়ের শঙ্কা যখন ঘনীভূত, বাংলাদেশের তাঁবুতে গাঢ় অন্ধকার জমাট, ধ্রুবতারার মতো জ¦লে আলো হয়ে তখন জয়ের নিশানা দেখিয়েছেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে অবিশ্বাস্যভাবে দলকে জয় এনে দিয়েছেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টি২০ ম্যাচেই ফিফটি হাঁকিয়ে। সপ্তম উইকেট জুটিতে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ এবং আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা জুটির রেকর্ড গড়েছেন। আন্তর্জাতিক টি২০তে ৮ নম্বর পজিশনের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডও স্পর্শ করেছেন। এই পজিশনে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ হাফ সেঞ্চুরিয়ান আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে। আর তাই বাংলাদেশের ক্রীড়ানুরাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ফোনে তাকে অভিনন্দিত করেছেন। বয়স ২০ হতে আর মাত্র ৭ দিন বাকি, আফিফ জানিয়েছেন দেশকে জেতানোর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। টি২০ ক্রিকেটে আফগান ‘জুজু’ অনেক বেশিই জেঁকে বসেছে বাংলাদেশ দলের ওপর। আজও কি আফিফ দ্যুতি ছড়িয়ে সেই ‘জুজু’ তাড়াতে পারবেন? বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তদের সঙ্গে আফিফ নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অফস্পিনার হিসেবে। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে হুট করেই অপরিচিত আফিফকে রাজশাহী কিংস খেলতে নামায় চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে। কারণ এই ম্যাচটির আগে প্রথম বিভাগে বিকেএসপির হয়ে ৬ ম্যাচ এবং অনুর্ধ-১৯ দলের হয়ে অনুশীলন ম্যাচে খেলেছিলেন আর রাজশাহী কিংসের নেট বোলার ছিলেন। সে সময় দলটির কোচ সারোয়ার ইমরানের সুনজরে পড়াতেই প্রথমবার কোন স্বীকৃত প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। সেই ম্যাচে ২১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে বিস্ময়ের জন্ম দেন যার মধ্যে ছিল টি২০ ক্রিকেটের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলের উইকেটও। মাত্র ১৭ বছর ৭২ দিন বয়সে অভিষেক টি২০ ম্যাচে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড ছিল সেটি। তার আগে লাহোর লায়ন্সের হয়ে পেসার জিয়াউল হক ১৭ বছর ১০৯ দিন বয়সে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন। অথচ আফিফ বিকেএসপি ও অনুর্ধ-১৯ দলের মূলত ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলেন এবং পাশাপাশি অনিয়মিতভাবে অফস্পিন করতেন। এরপর আফিফ নিজেকে ব্যাটসম্যান এবং বোলার দুই পরিচয়েই কিছু বিস্ময় ছড়িয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগে (বিসিএল) পূর্বাঞ্চলের হয়ে তার অভিষেক হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বিসিবি উত্তরাঞ্চলের বিপক্ষে সেই অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই ওপেনিংয়ে নেমে ১০৫ রানের ইনিংস উপহার দেন। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে প্রথম মৌসুম খেলতে নেমেই হ্যাটট্রিক করে চমকে দেন সবাইকে। আফিফ নিজেকে এভাবে মেলে ধরাতেই গত বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি২০ অভিষেক হয় মিরপুরে। কিন্তু সেই ম্যাচে চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে শূন্য রানেই সাজঘরে ফেরেন, দল থেকেও ছিটকে পড়েন। প্রতিভাবান এই তরুণকে অবশ্য উন্নতির জন্য সুযোগ দিয়েছে বিসিবি বিভিন্ন পর্যায়ে। এর মধ্যে তিনি ইমার্জিং দল, বাংলাদেশ ‘এ’ দল আর এইচপির হয়ে খেলে ব্যাটে-বলে নৈপুণ্য দেখিয়ে গেছেন। বিপিএলেও পারফর্মেন্স উজ্জ্বল ছিল তার। এবার ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (সিপিএল) টি২০ আসরেও সুযোগ পেয়েছিলেন সেন্ট কিটস এ্যান্ড নেভিস দলে। কিন্তু বিসিবি তাকে খেলার জন্য অনুমোদন দেয়নি জাতীয় দলের বিবেচনায় রাখার কারণে। অবশেষে প্রায় দেড় বছর পর টি২০ দলে ফেরেন আফিফ এবার। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম টি২০ ম্যাচেও খেলতে নামেন। তবে এবার ব্যাটিং পজিশন নেমে গেছে আটে। তখন ১৪৫ রানের লক্ষ্যে নামা বাংলাদেশ ধুঁকছিল ৬০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে। কিন্তু চার হাঁকিয়ে শুরু করা আফিফ মাত্র ২৪ বলেই তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত আউট হন ২৬ বলে ৮ চার, ১ ছক্কায় ৫২ রান করার পর। এমন ইনিংস যেদিন খেলেছেন, সেদিন স্বীকৃত ও অভিজ্ঞ সিনিয়র ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, সাব্বির রহমান ও সৌম্য সরকাররা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই গ্যালারিতে জাতীয় দলের আনকোরা মুখ এ তরুণকে নিয়েই দর্শকরা চিৎকার করেছেন ‘আফিফ, আফিফ’ বলে। বিষয়টি নিয়ে আফিফ পরে বলেছেন, ‘এ অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। অনেকদিন পর জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি এবং এমন একটা ভাল ইনিংস খেলার সুযোগ পেয়েছি। দর্শকরা অনেক খুশি, আমার কাছে এটা অনেক আনন্দের ছিল।’ আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে আট নম্বরে নেমে এটি মাত্র চতুর্থ অর্ধশতকের ঘটনা। এর আগে শ্রীলঙ্কার ইসুরু উদানা ৪৮ বলে ৮৪*, আয়ারল্যান্ডের সিমি সিংহ ২৯ বলে ৫৭* এবং কেনিয়ার রাঘেব আঘা ২৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তবে তাদের চেয়ে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ আফিফ। আর আট নম্বরে এ চারটি অর্ধশতকের মধ্যে সিমি, রাঘেব ও আফিফ প্রত্যেকে ২৪ বলে ফিফটি ছুঁয়েছেন। অর্থাৎ এই পজিশনে আন্তর্জাতিক টি২০তে আফিফ দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড স্পর্শ করেছেন। এছাড়া তিনি মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের সঙ্গে ৪৭ বলে ৮২ রানের যে জুটি গড়েছেন সেটি সপ্তম উইকেটে দেশের পক্ষে সেরা। আর আন্তর্জাতিক টি২০ ইতিহাসে এটি সপ্তম উইকেটে দ্বিতীয় সেরা জুটি। এ জুটিতে সর্বোচ্চ ৯১ রানের জুটি আছে ইংল্যান্ডের পল কলিংউড ও মাইকেল ইয়ার্ডির। অর্থাৎ আবারও বিস্ময়কর ঘটনার মধ্যে দিয়েই নতুন করে শুরু হলো আফিফের। আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে শূন্য থেকে শুরু করা আফিফ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেই বিস্ফোরক অর্ধশতকে দলকে জিতিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা। সে কারণেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফোনে অভিনন্দন ও শুভ কামনা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আফিফ বলেন, ‘শুধু শুভেচ্ছা জানাল, পুরো দলকে এবং আমাকে।’ তবে এমন একটি জয়ে ভূমিকা রাখতে পেরে উচ্ছ্বসিত আফিফ বলেন, ‘যখন ফিফটি হয়েছে খেয়াল করিনি। তখন চিন্তায় ছিল ম্যাচ যেন শেষ করতে পারি। ভাবনা ছিল ম্যাচ শেষে একটা উদ্করব। ম্যাচটা শেষ করতে পারিনি, তার আগে আউট হয়ে গেছি। সবারই ইচ্ছে থাকে এমন ইনিংস খেলে দেশকে জেতানোর। আমার সেই ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে।’ আফিফ নিজের ব্যাটিং নিয়ে সন্তোষও জানিয়েছেন। তবে এগিয়ে যেতে হবে তাকে আরও। একটি ম্যাচ জিতিয়েই বাংলাদেশের ভরসার নাম হয়ে গেছেন তিনি। তাই আফগানদের বিপক্ষে আজ আফিফের ওপর আস্থা থাকবে দলের। আজ আবারও কি সেই আস্থার প্রতিদান দিয়ে ‘ধ্রুবতারার’ মতো জ¦লে উঠতে পারবেন আফিফ?
×