ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গৌরাঙ্গলীলার লৌকিক রূপ, মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গৌরাঙ্গলীলার লৌকিক রূপ, মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা

মোরসালিন মিজান ॥ লোকসঙ্গীতের জনপ্রিয় একটি ধারার নাম ধামাইল। গানের কথায় সুরে রাধা কৃষ্ণের প্রেম। বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থাপনা। দেখে শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। মূলত সিলেট অঞ্চলের গান। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় এই ধারার গানের চর্চা হয়। একসময় ভাটিবাংলার উঠোনে উঠোনে পরিবেশশিত হতো ধামাইল। এখন নানা টানাপোড়েন। এরপরও ভালবেসে চর্চাটি অব্যাহত রেখেছেন স্থানীয় শিল্পী ও সংগঠকরা। সাম্প্রতিককালে ধামাইলের চর্চা নতুন গতি পেয়েছে। যতদূর জানা যায়, ‘ধামা’ থেকে ধামাইল শব্দটির উৎপত্তি। ধামা মানে উঠোন। অনেকের মতে, বাড়ির উঠোনে পরিবেশিত হয় বলেই এর নাম ধামাইল। ধামাইল নৃত্যগীতের প্রাণপুরুষ রাধারমণ দত্ত। দীন শরৎ, মহেন্দ্র গোসাই প্রমুখের কথা বাদ দিলে বর্তমানে ধামাইল গান বলতে রাধারমণের ধামাইল গীতকেই বোঝায়। এই ধারার অসংখ্য গান রচনা করেছেন তিনি। রাধারমণ দত্তের আচারকেন্দ্রিক বিভিন্ন সঙ্গীত রয়েছে। বাদ্যবরণ, সতুরকাটা, পানখিলি, পাশাখেলা, রূপসঙ্গীত ইত্যাদির গান মূলত ধামাইল গানের মোড়কে প্রকাশিত। ধামাইলের প্রাণ গ্রামীণ নারী। নারী শিল্পীদের দলবদ্ধ পরিবেশরনাই ধামাইল। ঘরের বউ ঝিরা এই ধারার গান পরিবেশন করেন। সম্মেলক গান বা নাচের প্রচলিত ভঙ্গি তারা অনুসরণ করেন না। বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে স্থান পরিবর্তন করতে করতে গান করেন। কোন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নেই। ১৫ থেকে ২০ জন নারী শিল্পী সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে হাতে তালি বাজান। পা দিয়ে মাটিতে মৃদু আঘাত করেন। এভাবে তাল রক্ষা হয়। বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামীর বর্ণনা মতে, ‘মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিয়ে ও পায়ে মাটিতে আঘাত করে তাল রক্ষা করে এই নাচ নাচে। কৃষ্ণ বা গৌরাঙ্গলীলার লৌকিক রূপ এই গানের বিষয়। এতে এক একটি বিষয় বা কাহিনী নিয়ে তার বিভিন্ন অংশ পর্যায়ক্রমে পরিবেশন করা হয়।’ সঙ্গীতের কিংবদন্তি হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর লোকসঙ্গীত সমীক্ষাতে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। ধামাইলের প্রশংসা করে তিনি লিখেছেন, ‘লৌকিক নৃত্যে বাংলাদেশ অত্যন্ত দীন, যাও বা ছিল তাও লুপ্তপ্রায় বা বিকৃত। কিন্তু শ্রীহট্টের মেয়েরা এক প্রাণবন্ত নৃত্যধারাকে প্রবাহিত রেখেছেন তাঁদের ধামাইল নৃত্যে। সেই ধামাইল নৃত্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ধামাইল গান। শ্রীহট্ট জেলার এ একান্তই নিজস্ব জিনিস।’ এই ধারার নৃত্য গীতের বিষয় বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার লোকসঙ্গীতে বৈরাগ্য ও বিচ্ছেদের অন্তর্লীন ভাবটি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু ধামাইল গান ভাবের দিক থেকে মূলত রাধা-কৃষ্ণ প্রেমকে অবলম্বন করে রচিত হলেও, সুরে ও ছন্দে তা বিরহ-বিচ্ছেদ বা বৈরাগ্যকে অতিক্রম করে পার্থিব উল্লাসে ভরপুর।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস ধামাইলের প্রকার ভেদ নির্ণয় করে লিখেছেন, ‘এর বহু রূপ আছে। কিন্তু সুরের দিক থেকে তা মূলত ভাটিয়ালির ঠাটের ভিতরেই। তবে ভাটিয়ালির টান বা মীড়ের আন্দোলন না থাকাতে প্রকাশভঙ্গি গেছে সম্পূর্ণ পালটে।’ একসময় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ছিল ধামাইল। এসব এলাকায় ধামাইলের ব্যাপক চর্চা হতো। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এখানেই শেষ নয়। ভারতের ত্রিপুরা করিমগঞ্জ কাছাড় আসাম হাইলাকান্দি শিলচর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ধামাইল চর্চা। এই ধারার গান না হলে বিবাহ, অন্নপ্রাসন, মঙ্গলাচরণ, জন্মদিনসহ সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তবে ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ঐতিহ্য ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যায়। শিল্পী সঙ্কট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ আরও নানা সীমাবদ্ধতার গল্প সামনে চলে আসে। অনেক পুরনো দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিষ্ক্রিয়তা দেখা দেয়। এসবের মধ্যেই চলে টিকে থাকার সংগ্রাম। এবং অতঃপর স্থানীয় সংগঠক ও শিল্পীরা জানাচ্ছেন, সচেতন প্রচেষ্টার ফলে গতি পেয়েছে ধামাইল চর্চা। এ প্রসঙ্গে কথা হয় শ্রীমঙ্গলের ধামাইল সংগঠক রামকৃষ্ণ সরকারের সঙ্গে। কয়েক বছর আগে জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে এ সঙ্গীতের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এবার বললেন, নতুন করে একটা জাগরণ তৈরি হয়েছে। ধামাইল বাঁচাতে স্থানীয়ভাবে কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ঢাকা থেকেও কিছু পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেছে। আগে শ্রীমঙ্গল এলাকায় আমার নিজের একটি দল ছিল। এখন আরও দুটি নতুন দল হয়েছে। দলগুলো নিয়মিত ধামাইল পরিবেশন করছে। নিজের উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, শিল্পী তৈরির লক্ষ্যে রুস্তমপুরে ধামাইল একাডেমি করেছি আমি। এখানে ধামাইল শেখানোর কাজ হচ্ছে। ২০১৭ সালে ঢাকার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শ্রীমঙ্গলে তিন দিনব্যাপী ধামাইল কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এরও সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি। আশাবাদী হওয়ার মতো খবর পাওয়া যাচ্ছে সুনামগঞ্জ থেকেও। এ জেলাতেও বেড়েছে ধামাইলের চর্চা। স্থানীয় শিল্পী ও সংগঠক শ্যামল দেব জানান, সদরে ‘শতদল’ নামে একটি দল সক্রিয় আছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ধামাইল নিয়ে কাজ করছে উদীচী। দিরাই, শাল্লা, মধ্যনগরেও নিয়মিত ধামাইল চর্চা হচ্ছে। সিলেট সদরেও আছে একটি দল। স্থানীয় মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি এসব ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে। এ প্রসঙ্গে সিলেটের তরুণ গবেষক সুমন কুমার দাস বলেন, আদি ভূমিতে ধামাইলের চর্চা বেড়েছে। নানাভাবে তা দৃশ্যমান। তবে নাচের প্রকৃত ঢংটি সব সময় অটুট থাকছে না। পরিবেশনায় কিছু তারতম্য দেখা যাচ্ছে। বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাজধানী শহরে ধামাইল নিয়ে কাজ করছেন রাধারমণের গানের শিল্পী ও সংগঠক বিশ্বজিৎ রায়। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় ধামাইলের চর্চা বেড়েছে। সুনামগঞ্জে চমৎকার একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। আমি সেখানে যোগ দিয়ে দেখেছি, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল এখানে ধামাইল পরিবেশন করতে আসে। চমৎকার স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশনা। এই চর্চা এগিয়ে নিতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
×