ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আফিফের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের জয়

প্রকাশিত: ১৩:০৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আফিফের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে  বাংলাদেশের জয়

মিথুন আশরাফ ॥ রায়ান বার্লের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের পাল্টা জবাব দিলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। আফিফের ব্যাটিং তান্ডবে শেষপর্যন্ত জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ত্রিদেশীয় টি২০ সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ৩ উইকেটে জিতল বাংলাদেশ। ২৬ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় ৫২ রানের অসাধারণ ইনিংস উপহার দিয়ে ম্যাচ সেরাও হয়েছেন আফিফ। তাকে দুর্দান্ত সমর্থন জুগিয়ে ৩০ রানে অপরাজিত থাকা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ৮২ রানের জুটি গড়েন। তাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ ২ বল আগে জেতা যায়। সিরিজে শুভ সূচনাও করে বাংলাদেশ। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জয়ের নায়ক আফিফ হোসেনসহ খেলোয়াড় ও দলের কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুক্রবার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কী ঝড়ো ব্যাটিংটাই না করলেন বার্ল। ৬৩ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে যখন জিম্বাবুইয়ে ধুঁকছে, ঠিক তখনই নিজেকে মেলে ধরলেন। সাকিব আল হাসানের এক ওভারেই ৩০ রান নিয়ে টি২০ ক্যারিয়ারে প্রথম হাফসেঞ্চুরিও করলেন। দলেরও ভরসা হয়ে উঠলেন। বার্লের অপরাজিত ৫৭ রানের সঙ্গে টিনোটেন্ডা মুতোম্বদজির অপরাজিত ২৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ১৮ ওভারে ১৪৪ রান করে জিম্বাবুইয়ে। দুইজন মিলে ষষ্ঠ উইকেটে ৮১ রানের জুটি গড়েই বাংলাদেশের সামনে জিততে ১৪৫ রানের টার্গেট দেন। এই টার্গেট অতিক্রম করতে গিয়ে বাংলাদেশও শুরুতেই ৬০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বসে। সেখান থেকে মোসাদ্দেক ও আফিফ মিলে ম্যাচ বের করে আনেন। ৭ উইকেট হারিয়ে ১৭.৪ ওভারে ১৪৮ রান করে জিতে বাংলাদেশ। টি২০তে সপ্তম উইকেটে রেকর্ড জুটিও হয়। বিশ্বকাপ থেকে, ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ থেকে যে হারতে থাকে বাংলাদেশ, টানা ছয়টি ম্যাচ হারে। বিশ্বকাপে ভারত ও পাকিস্তানের পর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে টানা তিন ওয়ানডে হারে। এরপর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে একমাত্র টেস্টেও হারে। জয়ের খোঁজে ছিল বাংলাদেশ। হারের গোলক ধাঁধা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছিল। অবশেষে সেই পথ মিলল। জিম্বাবুইয়েকে হারিয়ে জয়ের ধারায় ফিরল। স্বস্তি পেল বাংলাদেশ। টি২০তে এই রান খুব বেশি নয়। একজন ব্যাটসম্যান বড় ইনিংস খেললে আর একটা বড় জুটি হলেই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলেন জিম্বাবুইয়ে ক্রিকেটাররা, তাতে চ্যালেঞ্জ যে আছে, তার আলামত মিলে যায়। প্রথম ওভারেই ছক্কা হাঁকিয়ে লিটন কুমার দাস যেন কিছু একটা করার ইঙ্গিতও দেন। ব্যাটিংও করছিলেন খুব সুন্দর। ১৪ বলেই ১৯ করে ফেলেন। এরপর আর এগিয়ে যেতে পারেননি। দলের ২৬ রানের সময় টেন্ডাই চাতারার বলে স্ট্যাম্প ছেড়ে লেগ সাইডে গিয়ে খেলতে গিয়ে ইয়র্কারে বোল্ড হয়ে যান। চাতারা দুই হাত উঁচিয়ে হেলে দুলে যে ড্যান্স দেন, তাতেই যেন জিম্বাবুইয়ে ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাসী চিত্র ফুটে উঠে। সৌম্য দেখে-বুঝে খেলেন। কিন্তু তিনিও (৪) লিটন আউট হতেই কাইল জার্ভিসের গতির কাছে হার মানেন। জার্ভিসের উঠে আসা বলে মুশফিকুর রহীমও রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে ফেরেন। দলও বিপদে পড়ে যায়। বোলিংয়ে ডোবানোর পর ব্যাটিংয়েও দলকে খাদের কিনারায় ফেলেন সাকিব (১)। দলের ২৯ রানে গিয়ে চাতারার বলে আত্মঘাতী এক শটে ক্যাচ আউট হয়ে যান তিনি। দলের ৪৮ রানের সময় বার্লের বলে সাব্বির রহমান রুম্মন ক্যাচ আউট হওয়া থেকে না বাচলে দল মহাবিপদে পড়ে যেত। সেই বিপদ আসলই। রিভিউ নিয়েও বার্লের বলে এলবিডাব্লিউ থেকে বাঁচতে পারেননি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (১৪)। দলের ৫৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে হারের সম্ভাবনাতেই পড়ে যায় বাংলাদেশ। দিনটি যেন বার্লের। নেভিল মাদজিভার বলে সুইপ করে স্কয়ার লেগে শট নেন সাব্বির। বার্ল অনেকটা পথ দৌড়ে এসে সামনের দিকে ড্রাইভ দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে ক্যাচটি লুফে নেন। আফিফ হোসেন ধ্রুব ব্যাট হাতে নেমেই ঝলক দেখাতে শুরু করে দেন। ছক্কা-চার হাঁকাতে থাকেন। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও ছক্কার পর ছক্কা হাঁকান। দুইজন মিলে বাংলাদেশের যে আশা চলে যায়, তা আবার ফেরান। খেলায় আমেজ এনে দেন। ১০ ওভারে ৬৫ রান ছিল। সেখান থেকে পরের দুই ওভারেই ৩১ রান যোগ হয়ে যায়। ১৩তম ওভারে গিয়ে ১০০ রানও স্কোরবোর্ডে জমা হয়। মোসাদ্দেক ও আফিফ মিলে ৫০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। বিপদের মুহূর্তে হাল ধরেন। শেষমুহূর্তে গিয়ে ১৬তম ওভারে জার্ভিসের করা শেষ দুই বলে স্কুপ মেরে দুই বাউন্ডারি হাঁকিয়েই ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন আফিফ। ১২ বলে জিততে তখন ১৫ রান লাগে। ১৭তম ওভারে ১০ রান আসে। আফিফও ২৪ বলে হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। টি২০ ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই হাফসেঞ্চুরি করেন আফিফ। ৬ বলে জিততে ৫ রান লাগে। যখন ৫ বলে জিততে ৩ রান দরকার ছিল, এমন মুহূর্তে ২৬ বলে ৫২ রান করে আউট হয়ে যান আফিফ। মোসাদ্দেক ও তার ৮২ রানের জুটির অবসান ঘটে। তবে দলকে জয়ের বন্দরে রেখে যান আফিফ। সাইফউদ্দিন (৬*) ব্যাট হাতে নেমে ম্যাচ জিতিয়ে মোসাদ্দেককে (২৭*) নিয়ে হাসিমুখে মাঠ ছাড়েন। ২ বল বাকি থাকতে ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ। একটি বড় ইনিংস কিংবা বড় জুটি দরকার ছিল। আফিফ বড় ইনিংস খেলেন। মোসাদ্দেক ও আফিফ মিলে বড় জুটি গড়েন। তাতে জয়ও আসে। ত্রিদেশীয় সিরিজে শুভ সূচনাও করে বাংলাদেশ। শেষ ৮ ওভারে ৮৩ রান করে বাংলাদেশ। তাতেই জয় এসে যায়। খেলা শুরু হওয়ার কথা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। বৃষ্টিতে বিঘœ ঘটায় খেলা দেড় ঘণ্টা পর, ৮ টায় শুরু হয়। খেলা ১৮ ওভার করে হয়। টস জিতে বাংলাদেশ। আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তাইজুল ইসলামের টি২০ অভিষেক হয়। তাইজুল নিজের টি২০ ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই ব্রেন্ডন টেইলরকে (৬) আউট করে দেন। টি২০ ক্রিকেটে ১৬তম বোলার হিসেবে অভিষেক ম্যাচের প্রথম বলেই উইকেট শিকার করেন তাইজুল। এরপর অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজা ও ক্রেইগ আরভিন মিলে ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করতে থাকেন। দুইজন মিলে সপ্তম ওভারের মধ্যেই দলকে ৫০ রানে নিয়ে যান। দলের ৫১ রান হতেই এ দুইজনের জুটি ভেঙ্গে দেন মুস্তাফিজুর রহমান। আরভিনকে (১১) সাজঘরে ফেরান। দুইজনের ৪৪ রানের জুটি ভাঙ্গতেই যেন জিম্বাবুইয়ে ইনিংসেরও বারোটা বেজে যায়। প্রথম ওভার বোলিং করতে এসেই ঝলক দেখান মুস্তাফিজ। মাসাকাদজা ভরসা হয়ে ওঠেন। তিনি যেভাবে মারমুখী হয়ে খেলতে থাকেন, তাতে মুহূর্তেই স্কোরবোর্ডে রান জমা হতে থাকে। মাসাকাদজাকে ফেরানো খুব দরকার ছিল। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন সেই কাজটি করে দেন। ২৬ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় ৩৪ রান করা মাসাকাদজাকে আউট করে দেন সাইফউদ্দিন। সাব্বির রহমান রুম্মন মিড অফে অসাধারণ ক্যাচ ধরেন। দলের ৫৬ রান হতেই মাসাকাদজা আউট হওয়ার পর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত বল হাতে নিয়েই শন উইলিয়ামসকেও ফেরান। তাতে করে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় জিম্বাবুইয়ে। মুস্তাফিজ নিজের দ্বিতীয় ওভারেও আরেকটি উইকেট পেয়ে যেতেন। দলের ৬৩ রানের সময় রায়ান বার্লের ক্যাচটি মিড অফে ধরতে পারেননি সাইফউদ্দিন। তবে টিমিসেন মারুমার কপাল খারাপ। রান আউট হয়ে যান। ১০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ৬৪ রানের বেশি করতে পারেনি জিম্বাবুইয়ে। সাকিব ছাড়া যিনিই বল হাতে নিয়েছেন, শুরুতেই উইকেট শিকার করেছেন। টপাটপ জিম্বাবুইয়ের উইকেট নিতে থাকেন বাংলাদেশ বোলাররা। তাতে করে ধুঁকতে থাকে জিম্বাবুইয়ে। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ শিবিরে যেন কাঁপন ধরে যায়। ধুঁকতে থাকা জিম্বাবুইয়েকে এমন মোড় ঘোরান বার্ল, এক ওভারেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে জিম্বাবুইয়ে। ১৫ ওভারে ৯৫ রান ছিল। বার্ল করেছিলেন ২২ বলে ২৪ রান। সেখান থেকে ১৬ তম ওভারেই ১২৫ রানে চলে যায় জিম্বাবুইয়ে। ওভারটিতে ৩০ রান আসে। তাও আবার সাকিবের ওভারে! বার্ল এমনই ঝড়ো ব্যাটিং করেন, হাফসেঞ্চুরিও করে ফেলেন। ৬ বলে ৩০ রান নিয়ে ৫৪ রান করে ফেলেন। এই ওভারটিতে তিন ছক্কা, তিন চার হাঁকান বার্ল। ওভারের প্রথম বলে সুইপ করে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার দিয়ে ছক্কা হাঁকান। দ্বিতীয় বলে লং অন দিয়ে চার মারেন। তৃতীয় বলে রিভার্স সুইপ করে আবার চার হাঁকান। চতুর্থ বলে আবার ছক্কা হয়। পঞ্চম বলে আবার চার হাঁকিয়ে ষষ্ঠ বলে ছক্কা হাঁকান বার্ল। সাকিবের ক্যারিয়ারের কী করুণ এক ওভার গেল। এই ওভারেই জিম্বাবুইয়ে ম্যাচে ভালভাবে ফিরে আসে। এত সুন্দর বোলিং হচ্ছিল। অথচ সাকিবের এক ওভারেই খেলা যেন ইউটার্ন নিল। সাকিবের টি২০ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে বোলিংও হয়ে গেল। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধেই ২০১৬ সালে খুলনায় ৪ ওভারে ৪৫ রান দিয়ে বাজে বোলিং করেছিলেন সাকিব। এবার ৪ ওভারে ৪৯ রান দিয়ে সেই বাজে বোলিংকেও ছাড়িয়ে গেলেন। বার্লের এমন মহামারে প্রেরণা নিয়ে টিনোটেন্ডা মুতোম্বদজিও মারমুখী হয়ে খেলেন। পরের ওভারেই একটি ছক্কা হাঁকান। ১৩৬ রানে চলে যায় জিম্বাবুইয়ে। এমন মুহূর্তে পুরো স্টেডিয়ামে আলো নিভে যায়। ছয় মিনিট খেলা বন্ধ থাকে। ফ্লাডলাইট জ্বালানোর পর আবার খেলা শুরু হয়। শেষপর্যন্ত বার্ল ও মুতোম্বদজির ষষ্ঠ উইকেটে করা ৮১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ১৪৪ রান করে মাঠ ছাড়ে জিম্বাবুইয়ে। শেষ ৮ ওভারেই ৮০ রান আসে। বার্ল প্রথম টি২০ হাফসেঞ্চুরি করেন। ৩২ বলে ৫ চার ও ৪ ছক্কায় অপরাজিত ৫৭ রান করেন বার্ল। মুতোম্বদজি ২৬ বলে ১ চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ২৭ রান করেন। বার্লের ঝড়ো ব্যাটিং আর এই দুইজনের জুটিই শঙ্কা তৈরি করে। কিন্তু আফিফের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের সঙ্গে মোসাদ্দেকের সঙ্গে তার জুটি সেই শঙ্কা দূর করে জয়ও এনে দেয়। আফিফ ঝড়ে ত্রিদেশীয় সিরিজে শুভ সূচনাও করে বাংলাদেশ।
×