ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না

প্রকাশিত: ১০:১৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 সড়কে মৃত্যুর মিছিল  কিছুতেই থামছে না

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সড়কে মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। প্রতিদিনই ঝরছে বহু তাজা প্রাণ। খালি হচ্ছে মায়ের বুক। হাজার হাজার পরিবার পথে বসছে। অদক্ষ চালক, মাদকাসক্ত চালকদের যানবাহন চালানো, লক্কড় ঝক্কড় যানবাহন, ঢিলেঢালা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিয়ম না মেনে ওভারটেকিং, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, পেছনের বাসকে সামনে আসতে না দেয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সড়কে খানাখন্দ, সড়কের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় গতিসীমা না মানার কারণে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। এর মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে, দেশের অর্থনীতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ৫ সেপ্টেম্বর তুরাগ থানা এলাকায় ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন সঙ্গীত পরিচালক পারভেজ রব (৫৬)। তিনি প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক আপেল মাহমুদের চাচাত ভাই। এ ঘটনার দুদিন পরই একই কোম্পানির বাসের চাপায় নিহত পারভেজ রবের ছোট ছেলে মারাত্মক আহত হন ইয়াসির আলভি রব (১৯) নিহত হয় আলভীর সঙ্গে থাকা তার বন্ধু মেহেদী। এমন ঘটনায় নতুন করে আবারও সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। গত বছরের ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীবাহী জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। ওই ঘটনার পর ছাত্র বিক্ষোভে অনেকটাই অচল হয়ে পড়ে গোটাদেশ। টানা তিন দিন দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা ছিল শিক্ষার্থীদের হাতে। টানা এক সপ্তাহ অচল ছিল গোটা দেশের পরিবহন ব্যবস্থাপনা। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য নানা উদ্যোগের আশ্বাসের পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফেরে। তবে এর পরও সড়কে শৃঙ্খলা পুরোপুরি ফেরেনি। এজন্য প্রতিদিনই সড়ক মহাসড়কে ঘাতক যানবাহনের চাপায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিআরটিএর (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। সড়ক মহাসড়কে রেজিস্ট্রেশনকৃত বিভিন্ন প্রকারের প্রায় ২৯ লাখ যান চলাচল করছে। যদিও বাস্তবে এ সংখ্যা ৩৫ লাখ। এর মধ্যে অন্তত ২০ লাখ যান নিয়মিত যাতায়াত করে। বাকি ১৫ লাখ যানবাহনের মধ্যে প্র্রায় পাঁচ লাখ অনিয়মিত চলাচল করে। দেশে যে পরিমাণ রাস্তা রয়েছে তাতে ১৫ লাখ যান মোটামুটি ভালভাবে চলাচল করতে পারে। সারাবছর গড়ে দেড় লাখ যানবাহন গ্যারেজে থাকে। এই বিপুল সংখ্যক যানবাহন চালানোর জন্য রয়েছে প্রায় ১৬ লাখ বৈধ চালক। বাকি যানবাহনগুলোর স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে অবৈধ ‘ছোকরা‘ চালকরা। ফলে মহাসড়কের পাশাপাশি খোদ ঢাকার মতো যানজটপ্রবণ শহরেও সড়ক দুর্ঘটনা থেমে নেই। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, যেকোন আদর্শ নগরীর জন্য ওই নগরীর মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ সড়ক থাকতে হয়। ঢাকায় আয়তনের তুলনায় সড়ক রয়েছে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। এই ৮ ভাগের মধ্যেও শতকরা ৩০ শতাংশ সারাবছরই বেদখল থাকে। ঢাকায় সড়কের তুলনায় ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা বেশি। এটিও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া ট্রাফিক আইন অমান্য করে গাড়ি চালানো, লেন মেনে গাড়ি না চালানো, মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা ওভারটেকিং, অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, রাস্তায় খানাখন্দ, লক্কড় ঝক্কড় যানবাহন ইত্যাদি নানা কারণে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান স্বীকার করেন ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। ট্রাফিক আইন মানলে এমন দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। ঘটলেও তা হতো অনেক কম। পাশাপাশি অদক্ষ ‘বেপরোয়া’ চালকদের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। ট্রাফিক বিভাগ বলছে, নগরবাসীকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন করতে চালু করা হচ্ছে নানা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। রাজধানীর অন্তত ৭০ পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় বাতি মেরামত ও রাস্তার লেন মার্কিং করা হবে। ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের কমপক্ষে হাজার টাকা জরিমানা, ভুয়া চালকের লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ট্রাফিক আইন অমান্যকারী বৈধ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স তিন মাসের জন্য অকার্যকর করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকার রাস্তা থেকে ২০ বছরের অধিক পুরনো পাবলিক যানবাহন তুলে দেয়া হবে। এসব কাজ তদারকির জন্য ডিএমপি ১২ ডিসিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের আইন না মানার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের মানসিকতা। নগর-মহানগরীর রাস্তা এবং হাইওয়েগুলোয় ট্রাফিক সিগন্যালের বালাই নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রাফিক সার্জন বা পুলিশ গাড়ির সামনে গিয়ে না দাঁড়ান চালকরা তাদের গাড়ি থামানোর কোন প্রয়োজনই মনে করে না। ট্রাফিক সিগন্যাল চালু না থাকায় চালকদের এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে। অথচ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোন চালক ট্রাফিক আইন ভঙ্গের চিন্তা করে না। এ কারণেই চালকদের আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। আইন অমান্যকারীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবেই চালকদের শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব হবে। অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনা কমবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসেব অনুযায়ী, দেশে যত সড়ক মহাসড়কে রয়েছে, আর যত যানবাহন চলাচল করছে তা রীতিমতো বিস্ময়ের বিষয়। সড়ক-মহাসড়কে অধিক যান চলাচল, সড়কের দু’পাশের শতকরা ৫০ ভাগ বেদখল থাকা, সড়ক মহাসড়কে খানাখন্দ, লক্কড় ঝক্কড় যানবাহন, অদক্ষ চালক, ধারণ ক্ষমতার অধিক মাল নিয়ে যান চলাচল, গতিসীমা না মানা, মাদকসেবন করে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, পাল্লাপাল্লি করে ড্রাইভিং, চালকদের বেপরোয়া স্বভাব, দুর্ঘটনাপ্রবণ অনেক জায়গায় নিয়ন সাইনবোর্ড না লাগানো (অনেক দূর থেকে দেখা যায় এমন সাইনবোর্ড), ছিনতাই চুরি ও ডাকাতির মতো অপরাধের ও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যায় গড়ে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ, চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে অন্তত ৩০ হাজার। এদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। নিহত বা পঙ্গুত্ববরণকারীদের পরিবারগুলোর অধিকাংশই পথে বসে হয়। তাদের সংসারে নেমে আসে দুর্বিষহ অভাব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল মুক্তাদির জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। অন্তত ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। সেই পরিকল্পনায় দেশের জনসংখ্যা বিশ বছর পর কত হবে, তত মানুষের জন্য কত যানবাহন প্রয়োজন, আর সেই সংখ্যক যানবাহন চলতে সড়ক মহাসড়ক দরকার সেই হিসেব করে সড়ক মহাসড়ক নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তিনি বলেন, দেশে সাধারণত বিটুমিন দিয়ে সড়ক-মহাসড়ক নির্মিত হয়, যা দামে সস্তা। ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাস্তা বেহাল হয়ে পড়ে। এজন্যও দুর্ঘটনা বাড়ে। একবার পানি উঠলেই পুরো সড়ক নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকার সড়কগুলোর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। নষ্ট সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। সড়ক ছাড়াও চালকদের মাদকসেবন, বেপরোয়া স্বভাব, ট্রাফিক আইন না মানা, পাল্লাপাল্লি করে যাওয়া, বাড়তি টাকা রোজগারের জন্য বেশি যাত্রী ওঠানোর জন্য তাড়াহুড়োসহ নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। দেশের সূদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা জরুরী। এতে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে দীর্ঘস্থায়ী মহাসড়ক নির্মাণসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদ- হয়, তাহলে সড়ক মহাসড়ক দেশের মেরুদন্ড। এই মেরুদন্ড শক্ত করতে উচিত বিটুমিনের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মোতাবেক কংক্রিটের সড়ক মহাসড়ক নির্মাণ করা। কারণ বিটুমিনের সড়ক মহাসড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। মেরামত করতে গেলেই রাস্তার এক পাশ বন্ধ করতে হয়। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজটে নষ্ট হয় বহু কর্মঘণ্টা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর নষ্ট রাস্তায় দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। ভারত মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্প্রতি উন্নতমানের কংক্রিট ব্যবহার করছে। ভাল কংক্রিট দিয়ে মহাসড়ক নির্মিত হলে অন্তত বড় ধরনের কোন বিপর্যয় না হলে ৪০ বছর সেই মহাসড়কে আর হাত দেয়ার বিশেষ কোন প্রয়োজন হয় না। বর্তমান সরকার দেশে কংক্রিটের সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। সড়ক-মহাসড়কের পাশের অবৈধ স্থাপনা, দোকানপাট সরিয়ে দিলে যানজট কমে যাবে। দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। থামবে সড়কে মৃত্যুর মিছিল।
×