ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

রূপসী রাজকন্যার চোখের জল, ট্রি অব সরো

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রূপসী রাজকন্যার  চোখের জল,  ট্রি অব সরো

শিউলির কথা লিখতে বসলেই আবিদ আজাদের প্রিয় পঙ্ক্তির কথা জানি না কেন মনে পড়ে যায়। প্রেমিক কবি লিখছেন: যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি...। কবি নেই। কেমন আছেন তার প্রেমিকা? আমরা জানি না। তবে শিউলি গাছ আছে। মরা নয়। বরং ভাদ্রের বৃষ্টিতে ভিজে সবুজ সতেজ হয়েছে। আশ্বিন আসি আসি করছে যখন, ফোটছে ফুলও। অনেকে মনে করেন, শরত শুরু মানেই শিউলি ফোটার শুরু। আসলে তা নয়। মূলত আশ্বিনের ফুল। ভাদ্রের একেবারে শেষভাগে এসে একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছে। এবারও ঢাকার শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে দেখা হলো শিউলির সঙ্গে। খুব ভোরে ওঠা গেলে ভাল হতো, গাছেই পাওয়া যেত ফুলটিকে। তা হলো না। শুক্রবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাগানের মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে শিউলি। কাছে যেতেই মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। স্নিগ্ধ অনুভব। মুহূর্তেই মনটা ভরে গেল। আজকাল মানুষের কত বড় বড় চাওয়া। সবুজ ঘাসের গায়ে উপুড় হয়ে থাকা সামান্য শিউলি কুড়ানোর আনন্দ তারা নিতে শেখেনি। তাতে কী? যারা ফুলপ্রেমী, তাদের জন্য ঠিক ফোটছে শিউলি। এ ফুল রাতে ফোটে। সকাল হতে না হতেই ঝড়ে পড়ে যায়। এত সৌন্দর্য, এত যার ঘ্রাণ, তার কিনা এত ছোট জীবন? ভাবতে খারাপ লাগে। এ প্রসঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ সেই রাজকন্যার গল্পটি উল্লেখ করা যেতে পারে। পুরাণে বলা হচ্ছে, অপরূপ সুন্দরী দেখতে ছিল রাজকন্যা। তার রূপের কথা বলে শেষ করা যায় না। বর্ণনা করবে, কার আছে সাধ্য? অপরূপা রাজকন্যাকে সবাই নিজের করে পেতে চায়। আর রাজকন্যা চায় সূর্যকে। দূর আকাশে থাকা সূর্যকে সে সবটুকু দিয়ে ভালবেসেছিল। হায়, সূর্য তা বোঝে না! থেকে যায় দূর আকাশে। অধরা। প্রত্যাখ্যাত হন রাজকন্যা। বুক ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় তার। হারানোর ব্যথা সইতে না পেরে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজকন্যা। বেছে নেয় আত্মহননের পথ। শাস্ত্র মেনে দাহ করা হয় রাজকন্যাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! মৃত্যুতে শেষ হয় না সব। রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। গাছে চমৎকার ফুল ফোটে। রাতে ফোটে। সকালে সূর্যের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। অশ্রুবিন্দুর মতো ঝরে যায়। রাজকন্যার নামে এই ফুলের নামকরণ করা হয় ‘পারিজাতিকা।’ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এ ফুল বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য। হয়তো তাই নজরুল লিখেছেন: দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। সাদা সুগন্ধী ফুল পারিজাত, পারিজাতা, পারিজাতাকা নামেও পরিচিত। প্রচলিত অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্পি, খারাপাত্রাকা ও প্রজক্তা। তবে যে নামটি বললে চট করে চিনে ফেলা যায় সেটি- শিউলি। এ নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি। বৈজ্ঞানিক নামটি নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস। ল্যাটিন শব্দ নিক্টান্থেস অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। আরবর-ট্রিসটিস হচ্ছে বিষণ্ণ গাছ। চোখ জোড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাবার পরও অল্প সময় বেঁচে থাকে বলে এমন নামকরণ। একই কারণে শিউলি গাছকে বলা হয় ট্রি অব সরো। দেশের বিভিন্ন স্থানে আছে শিউলি গাছ। পরিমাণে খুব বেশি হবে না। তবে আছে। এর যেমন সৌন্দর্য, তেমনি মিষ্টি ঘ্রাণ। এ কারণে বহু কাল ধরে সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে শিউলি। কবি, সাহিত্যিক শিল্পীরা বরাবরই বিশেষ ভালবাসা দেখিয়েছেন শিউলির জন্য। কবিতা, গান, নাটক, চলচ্চিত্র সর্বত্রই এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণের আরেকটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে। গল্পটি এরকম : কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রক্তকমিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে ভরে ওঠুক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! তবুও কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন তিনি। এর ফুল রক্তমিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়। এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তো ঘটনা জেনে ভীষণ রেগে যান। তিনি বিষ্ণু অবতারের ওপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এ কারণে কৃষ্ণকে শাপ দেন, কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই। কোনদিন ফল আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। ঘটনা তাই ঘটেছিল কিনা, সেটি অন্য আলোচনা। তবে শিউলির মতো চমৎকার একটি ফুল ঠিকই পাওয়া হয়েছিল। কবিতায় আসা যাক। শিউলির বন্দনা করে কবিগুরু লিখেছেন: শিউলিতলার পাশে পাশে/ঝরা ফুলের রাশে রাশে/শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে/অরুণ-রাঙা-চরণ ফেলে/নয়ন-ভুলানো এলে...। শিউলির কথা বেশি এসেছে নজরুলের কবিতায়। সকালে সবুজ ঘাসের ওপর অজ¯্র শিউলি পড়ে থাকে। কবি একে বলেছিলেন শিউলি-বিছানো পথ। বিরহের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে শিউলিকে আশ্রয় করেছেন তিনি। লিখেছেন: শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই...। গ্রামে মেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে শিউলি কুড়োতে যায়। আঁচল ভর্তি ফুল থেকে একটি একটি করে নিয়ে মালা গাঁথে তারা। খোঁপা সাজায়। রাজধানী শহরেও প্রচুর বিকোয় শিউলি ফুলের মালা। দূরন্ত ছেলে মেয়েদের ‘মালা কিনবেন আপা’ আহ্বানে সারা না দিয়ে উপায় আছে কারও? শিউলির ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্তটি কমলা রঙের টিউবের মতো দেখতে। তবে গাছটি সাদামাটা। এটি নরম ধূসর ছাল বা বাকল বিশিষ্ট হয়। লম্বায় ১০ মিটারের মতো। গাছের পাতা ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকাজুড়ে শিউলি ফুটে। শুধু তাই নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রধান ফুল। আর বাংলাদেশে? শিউলি ছাড়া আস্ত একটা ঋতু অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিবর্ণ হয়ে যায় শরত। ফুলপ্রেমীরা এর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এবারের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা...। পল্লীবালারা শিউলি কুড়াতে ব্যস্ত এখন। আশপাশে কোথাও হয়তো আপনার শিউলিটি ফোটে আছে। কুড়িয়ে নিতে ভুলবেন না যেন!
×