ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধন বৈষম্য বৈশ্বিক সমস্যা

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ধন বৈষম্য বৈশ্বিক সমস্যা

বিশ্বব্যাপী ধন বৈষম্য ক্রমশ বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত সব দেশেই ক্রমান্বয়ে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন, দারিদ্র্যের শিকার লোকজন কিছুটা মানব উন্নয়ন সূচকে লাভবান হলেও বৈষম্যের আকার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিশিষ্ট নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিজ বলেছেন, বর্তমান ১% স্বর্ণের প্রহেলিকায় ৯৯%-এর ভবিষ্যতকে ক্ষুণœœ করছে এটি একটি বাস্তব ও শক্তিশালী ধারণা। স্টিগলিজ যথার্থই বলেছেন, সম্পদ কেবল ক্ষমতার জন্ম দেয় না, বরং আরও সম্পদশালী এবং ধনবান করে তোলে। বর্তমানে বহু গণতান্ত্রিক দেশে কর্পোরেটগুলো এত শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে- তারা কখনও কখনও সরকারের চেয়েও অধিকতর ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। সরকার ক্ষমতাতন্ত্র কর্পোরেট সংস্কৃতির মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন বিশ্বব্যাপী ক্রমশ গড়ে উঠছে- যা অভিজাত শ্রেণী তৈরি করছে- যারা নানা উপায়ে ধন সম্পদের পাহাড় বিশ্বব্যাপী গড়ে তুলছে। এ ধরনের কর্মকা-ের কারণে দরিদ্র মানুষেরা বিশ্বব্যাপী বঞ্চিত হচ্ছেন- আর বৈষম্যের শিকার মানুষেরা অদৃশ্য শৃঙ্খলে শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতো হাসতে বাধ্য হোন। ১% ধনিক শ্রেণীর জন্য সাধারণ মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছেন। একটি সমঅধিকারসম্পন্ন এবং টেকসই বিশ্বের স্বপ্ন দেখা মানুষেরা বাস্তবে দেখতে পাচ্ছে, দেশে দেশে নানামুখী অন্যায় কর্মকা-, তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশ শ্রেণীকে মাদক, অস্ত্র এবং অন্ধকার জগতে ডুবিয়ে দেয়া, ক্ষমতার মদমত্তে পারস্পরিক হানাহানি, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ভেদে বৈষম্যের শিকার হওয়ায় মানবতাবোধ সম্পূর্ণরূপে উধাও হয়ে যেতে বসেছে। বৈষম্যের আকার এত প্রকট হয়ে উঠছে যে- পুঁজি পাচার হচ্ছে। পুঁজি ছয় ধরনের হয়ে থাকে : বহিঃস্থ অর্থনৈতিক পুঁজি, প্রাকৃতিক পুঁজি, মানবীয় পুঁজি, সামাজিক ও সম্পর্কিত পুঁজি এবং নির্মিত পুঁজি। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে- যা আগামীতে বিশ্বের দ্রুত ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রের তিনটির একটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। বিবিএসের একটি হিসাবে দেখা যায় যে, ২০১৬ সালে গিনি সোনা ছিল ০.৪৮২ যা কিনা ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮। এটি হ্রাস করার জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে যারা বাস্তবায়নের ভার নিয়েছেন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পর্যালোচনা করা দরকার। সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সেমিনারে বরণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছে। তিনি যেসব সুপারিশ করেছেনÑ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কাঠামো তাকে সুসংসহ করা যাতে করে ধনবানদের সম্পদের অপব্যবহার থেকে দূরীভূত করা যায়। তার এ সুপারিশসমূহ এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দিকনির্দেশনাস্বরূপ। কেননা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও ধন বৈষম্যও ক্রমশ বাড়ছে। যদিও সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে ধন বৈষম্য হ্রাস করে মানব সম্পদ উন্নয়নে চেষ্টা করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এদেশের ধনিক শ্রেণীর একটি অংশ যেমন পুঁজি আর্থিক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাত থেকে নিলে তা আর ফেরত দিতে চায় না; তেমনি তাদের প্রতিষ্ঠানে যারা কর্ম করে থাকে তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দিতে চায় না। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে সাদা কোলার (ঈড়ষষধৎ) এবং ব্লু কোলার শ্রম সম্পদ আমদানি করে থাকে। অথচ আমাদের দেশের যুব সম্পদের একটি বড় অংশ কর্মপ্রত্যাশী। দুর্নীতি সব অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে বিদ্যমান কিন্তু এটিকে সহনীয় পদ্ধতিতে রূপান্তর করা দরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান রূপ ছিল তা এখনও পুরোপুরি হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে উচ্চ দারিদ্র্যের হার বার্ষিক ১.২৫% হারে হ্রাস পেয়েছিল এবং একই সময়ে চরম দারিদ্র্যের হার বার্ষিক ০.৮০% হারে হ্রাস পেয়েছে। দারিদ্র্য ২১.৮% হারে হ্রাস পেয়েছে ২০১৮ সালে যেখানে ২০১৬ সালে ছিল ২৪.৩%। অন্যদিকে চরম দারিদ্র্যের হার ১১.৩% ছিল ২০১৮ সালে যেখানে ২০১৬ সালে ছিল ১২.৯%। দারিদ্র্যের হার হ্রাস অবশ্যই দেশের জন্য অনেক বেশি দরকার। মানুষের মধ্যে তার নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদার মধ্যে বন্টন ব্যবস্থা; সরবরাহ-চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা দরকার। সরকার যে গ্রামকে আধুনিক নগরে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর সেক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি শ্রেণী কালে কালে ক্ষমতাতন্ত্রের কাছাকাছি থেকে সকল সুযোগ-সুবিধা আদায় করে থাকে। মাঝখান থেকে সরকারের অগ্রযাত্রা বিভিন্ন দেশে ব্যাহত হয়। যে দূরদর্শিতা নিয়ে সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়নে যাদের নিয়োগ করা হয় তারা যেন সৎ, নির্ভীক এবং সরকারের সদিচ্ছা বাস্তবায়নে আন্তরিক হোন। প্রফেসর স্টিগলিজ ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিকালে মন্তব্য করেছিলেন যে, সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়া দরকার যে সমস্ত সংস্থা ক্রীড়ার জন্য নিয়মগুলো তৈরি করে থাকে যার দরুন সমগ্র বিশ্বে কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবনকে তারা প্রভাবিত করে ক্রমাগতভাবে অর্থনীতিতে ভুল করে চলেছে এবং প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে তার প্রশ্নবিদ্ধভাবে কর্মসূচী পালন করে চলেছে। ২০০১ থেকে ২০১৯ এ সময়ের মধ্যে ওই কয়েক মিলিয়ন মানুষের জায়গায় কয়েক বিলিয়ন হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধন বৈষম্য হ্রাস পায়নি। বরং ক্রমান্বয়ে তা বেড়ে চলেছে। আর্থিকভাবে দরিদ্র শ্রেণী, আরও দরিদ্রতর হচ্ছে, নিঃস্ব আরও নিঃস্ব হচ্ছে। এ ধরনের করুণ অবস্থায় ধনবাদীরা ক্ষমতা জাহির করে। সাধারণ মানুষকে অভুক্ত, অত্যাচারিত করে, গৃহহীন করে ফায়দা তোলে। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে অস্ত্র তুলে বিক্রি করে আয় রোজগার আরও বাড়ায়। এদিকে শোষণ-বঞ্চনা মানুষকে প্রতারিত করে থাকে। প্রযুক্তির বিকাশ ক্রমবর্ধমান ধনিক শ্রেণীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণী উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে। বরং সমাজে সামাজিক নেটওয়ার্কিংয়ের ভাল ব্যবহারের বদলে যারা অসৎ পথে পা বাড়ায় তাদের সহায়ক শক্তিতে রূপান্তর হয়। ইদানীং দেশে গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, অভিভাবকদের নিজ সন্তান-সন্ততিদের প্রতি খেয়াল রাখা দরকার। কিশোর-কিশোরীদের কেউ কেউ এ গ্যাং কালচার অর্থ মাদক-অস্ত্রের নেশায় বুদ হচ্ছে- যা দেশের জন্য অশনি সঙ্কেত। এ সমাজে নিয়ামক শক্তি হওয়া উচিত সামাজিক প্রতিরোধ। কিশোর-কিশোরীরা যাতে ভুল পথে পরিচালিত না হয়, সে জন্য যথার্থ অর্থে একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্ছনীয়। সামাজিক বিভাজন এবং নব্য ধনীদের কারণে অর্থ প্রতিপত্তি দেখতে গিয়ে যে গ্যাং কালচার তৈরি হয়েছে তা সমূলে উৎপাটিত করা দরকার। এদেশে এখন ব্যাংকিং এবং নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। বড় বড় ঋণ খেলাপীকে যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের অন্যায় কর্মকা- থেকে বিরত থাকবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আচরণগত সমস্যা, ঋণ খেলাপীর সংক্রান্ত সংকট, নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্র তৈরি, নারী উদ্যোক্তা কমার কারণ উদঘাটন, সমাজে উদ্ভাবনীমূলক কর্মকা-ের প্রসার ঘটাতে স্টার্ট আপ ভেঙ্কার চালুর জন্য যে শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। ঋণ বিতরণ নীতিমালা জনসম্মুখে প্রকাশ করা দরকার- যাতে সাধারণ মানুষ ঋণ উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পান। এটি অনস্বীকার্য যে, আমাদের দেশে সব সমস্যা সমাধানের জন্য জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী। দুর্বল ব্যাংকসমূহ ও লিজিং কোম্পানিগুলোকে মার্জার করার জন্য প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করা যেতে পারে। একই পরিবারের কাছে যাতে অধিক সংখ্যক ব্যাংকের মালিকানা নামে-বেনামে না থাকে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ধন বৈষম্য কমাতে সরকার বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে অবশ্য যারা অন্যায়ভাবে বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন, মাদক সাম্রাজ্যের গডফাদার হচ্ছেন বলে পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে, সেগুলো দমনে সচেষ্ট হতে হবে। যারা বিদেশে হুন্ডি বা মানিলন্ডারিং করে থাকেন, নিশ্চয়ই তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থা ও দুদক তদন্ত করলে তথ্য পাবেন। এদের দমন করতে হবে। এদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল তাদের অধিক হারে বাস্তবমুখী ও প্রায়োগিক কলাকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। গ্রামীণ উন্নয়ন যেভাবে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সরকার করেছে, কর্মসংস্থানেও সে ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। এটি একটি বিশেষ মহলের হাতে থাকলে বণ্টন ব্যবস্থায় সুষম এবং ন্যায্য বিচারের ক্ষেত্রে একটু সমস্যার উদ্রেক করতে পারে। সুবিধাভোগীরা যেন বার বার সুবিধা না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। বিদেশে ধন বৈষম্য আমাদের দেশে যেন হ্রাস পায়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ [email protected])
×