ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এক উন্মাদ সংবাদকর্মীর গল্প

প্রকাশিত: ১৩:২২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

এক উন্মাদ সংবাদকর্মীর গল্প

হাতে গরম কফির মগ নিয়ে খবরের কাগজে বা টেলিভিশন সেটে আমরা প্রতিদিনই বিশ্বের নানা প্রান্তের যুদ্ধের খবর দেখে থাকি। যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরে মানবতার পরাজয় আমাদের কাঁদায়, হোয়াইট ফসফরাসের মতো ভয়াবহ রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার দেখে আঁতকে উঠি আমরা। কিন্তু অনেক সময় আমরা একেবারেই ভুলে যাই কিছু মানুষের কথা; যারা কিনা নিজেদের জীবন ঝুঁকি নিয়ে শুধু ‘চজঊঝঝ’ লেখা জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গুলি-বোমার মধ্যে দিয়ে এবং আশা করছেন ‘চজঊঝঝ’ লেখাটি তাকে বন্দুকের নিশানা হওয়া থেকে বাঁচাবে। কিন্তু সাংবাদিক বা মিডিয়াকর্মীর পরিচয় সবসময় কারও জীবন বাঁচায় না, বরং ঘাতকের লক্ষ্যও বানিয়ে ছাড়ে অনেক সময়। যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক সিনেমাতেই এসেছে। পরিচালক ম্যাথু হেইনেমান একটু ভিন্ন ধাঁচের কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাদের জীবন বাজি আর দুঃসাহসে বিশ্ববাসী জানতে পারে সেসব খবর তাদেরই তিনি আনলেন ক্যামেরার সামনে। বেছে নিলেন সাংবাদিক ম্যারি কলভিনের গল্পকে। সাংবাদিকতার সাহসিকতা দেখাতে এই উন্মাদ মহিলার চেয়ে আর ভাল গল্প কার হতে পারে? পেশাদারিত্ব থেকে একজন মানুষ কতটা ঝুঁকি নিতে পারে? ম্যারি কলভিন তার পেশাকে বানিয়ে ফেলেছিলেন নেশাতে। বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই সংঘাতের সময় জনগণের আর্তচিৎকার কম শোনা যায়। রাজনীতি আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় হারিয়ে যায় নিরীহ জনতার বারুদে পোড়ার ঘটনা। ম্যারি কলভিন নিজের কাঁধে সেই গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন। ’৮০-এর দশকে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে এক তামিল যোদ্ধার সাক্ষাতকার নিয়ে ফেরার পথে সরকারী বাহিনীর হামলার মুখে পড়েন। প্রাণে বেঁচে গেলেও এক চোখ হারান তিনি। থেমে থাকেননি একদমই। বরং যুদ্ধ আক্রান্ত অঞ্চলের ভেতরে প্রবেশের নেশা পেয়ে বসে তার। ১৯৯৯ সালে ইস্ট তিমুরের রণাঙ্গনে তিনি নিজেই বিদ্রোহ করে বসলেন। ২২ মিডিয়াকর্মীকে বিদায় জানিয়ে একাই থেকে গেলেন ১৫০০ নারী এবং শিশুর সঙ্গে। একের পর এক খবর জানিয়ে গেলেন বিশ্ববাসীকে। মিডিয়াকর্মী যেখানে উপস্থিত সেখানে আর গণহত্যা চালায় কিভাবে প্রতিপক্ষ? বেঁচে যায় ১৫০০ প্রাণ। চেচনিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে, যুদ্ধের ঘ্রাণ যেখানেই পেয়েছেন ছুটে চলেছেন সেখানে। এক সাক্ষাতকারে নিজে বলেছিলেন আমার কাজ মানবতায় চরম আঘাত প্রত্যক্ষ করা এবং সেটা জানানো। কামানের গোলা ১২০ মিলিমিটার না ১৫৫ মিলিমিটার সেটা নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আরব বসন্তের সময় ঘুরে বেড়িয়েছেন মরুর বুকে। একনায়কদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন সব ধরপাকড়ের খবর। ক্ষ্যাপাতে স্বৈরশাসক গাদ্দাফির প্রাসাদে বসে তাকেই জর্জরিত করেছেন প্রশ্নবাণে। পেশাদারিত্বের নেশায় ছুটে গিয়েছিলেন ইরাক যুদ্ধেও! নিপীড়িত মানুষের কান্নার কথা বার বার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে বেশ কিছু শত্রুরও জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতির অন্যতম সংঘাত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যখন কোন পশ্চিমা সংবাদকর্মী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিল না তখন তিনিই আবার গুরুদায়িত্ব নেন। তার সংবাদ সংস্থা থেকে সিরিয়া যেতে না করা হলেও সেসব তিনি কানেই তোলেননি। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রবেশ করেন এই দশকের অন্যতম যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর হোমসে। সিরিয়ার সরকার যে মিথ্যার দোহাই দিয়ে নিরস্ত্র জনগণের ওপর বোমা ফেলার কাজটাই বেশি করছে সেটা তার কল্যাণে দুনিয়া জানতে পারে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোন শহর হলেই সেই শাস্তি হিসেবে সেই শহরের সমস্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। অধিকারের বদলে জুটছে বোমা! আর এসবের ভুক্তভোগী হচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন সাধারণ জনগণ যাদের আসলে যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক পর্যন্ত নেই! ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়া সরকারের গোয়েন্দা ড্রোন ফোনের সিগন্যাল ধরে তাকে খুঁজে বের করে। এরপর তার ভাগ্যে ছিল কামানের গোলা। ম্যারি কলভিন যাদের গল্প বলে এসেছিলেন মুহূর্তেই চলে যান তাদের দলে। অ ঢ়ৎরাধঃব ধিৎ সিনেমার তারই বায়োপিককে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। ম্যারির চরিত্রে অভিনয় করেছেন রোজামন্ড পাইক। পেশাগত জীবন ছাড়াও ম্যারি কলভিনের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অংশও দেখানো হয়েছে সিনেমাতে। ডকুমেন্টরি ধাঁচের এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য, গতিতে কিছু পরিবর্তন আসলে একটা মাস্টারপিস হতে পারত। এছাড়াও ব্যাড পড়েছে তার অনেক সহকর্মীদের কথা, যারা তার সঙ্গেই ছুটে চলত। তারপরেও এ প্রাইভেট ওয়ার জয় করেছে মানুষের মন, কাঁদিয়েছে দর্শককে।
×