ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিক বাঁচলে বাঁচবে অর্থনীতি

প্রকাশিত: ১১:৫৪, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শ্রমিক বাঁচলে বাঁচবে অর্থনীতি

স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বাংলাদেশ ছিল কৃষি নির্ভর প্রান্তিক অর্থনীতির দেশ। কেবলমাত্র পাটজাত দ্রব্য ও কাঁচামাল ছাড়া কোন রপ্তানি পণ্য ছিল না। যদি ভালভাবে লক্ষ্য করি, তবে দেখা যাবে- রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপিতে অবদান বৃদ্ধি, যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান লক্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য। আামদের সেই স্বাধীনতার মাত্র ৭ বছর পরে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছা এবং দশ লাখের অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা এ শিল্পের জন্য অনেকটা কল্পনাতীত ছিল। আর এই শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমিকের সিংহ ভাগ নারী শ্রমিক যার অধিকাংশ গ্রাম এলাকার হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা। অপ্রত্যাশিত একটি অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পোশাক শিল্প আজ বাংলাদেশকে বিশ্বে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এটা অকপটে স্বীকার করতে হয়, পোশাক শিল্প দেশের শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ৪০ লক্ষ শ্রমিককে উৎপাদনশীল কাজে অন্তর্ভূক্ত করে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখেছে। এ শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। পোশাকের চাহিদা কোনদিনই কমবে না। বর্তমানে বিশ্বে এই পণ্যের বাজার ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের। চীন একাই ১৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৩৫.৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অংশ ৫.৪ শতাংশ (২৪.৪৯ বিলিয়ন ডলার)। প্রথম দিকে যেনতেন ভাবে করাখানা গড়ে উঠেছে। শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, পৃথক গার্মেন্টস ভিলেজ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। এতদিন ক্রেতাদের চাহিদা মত পণ্য তৈরী হয়েছে। স্বল্প মেয়াদী লাভের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থ গুরুত্ব পায়নি। উপেক্ষিত হয়েছে পণ্য বৈচিত্রকরণ, দক্ষতা ও গবেষণা। এতো কিছুর পরও গত ৩৫ বছরের চড়াই উৎড়াই পার হয়ে আজ দেশের পোশাক খাতে আবির্ভূত হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ এবং অস্থিতিশীল বিশ্ব বাজার। দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও এই শিল্পের শ্রমিকের জীবন-জীবিকার মানে বিশেষ কোনো পরিবর্তনই আসেনি। আামদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পোশাক রপ্তানির কারণেই আমাদের অর্থনীতিতে আমদানি-রপ্তানি ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমান রপ্তানি আয় দিয়ে ৮০ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়েছে। তেমনিভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। পোশাক শিল্পের বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে অনেক সহযোগি শিল্প ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ। সামগ্রিকভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এবং সহযোগী শিল্প ও সেবা খাতের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ফলে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়েছে যা দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সত্তর দশকে বাংলাদেশ কেবলমাত্র কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল আর বর্তমানে রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই শিল্প পণ্য যা উন্নয়নশীল দেশে অনন্য। এক কথায় বলা চলে, শ্রমিকের অকৃত্রিম শ্রম দানের ফলেই আমাদের অর্থনীতির আকাশে আজ সূচকে সূচকে অগ্রগতি। তাই তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারকে সবার প্রথমে কঠোর হতে হবে। একটি উৎপাদনমুখী শিল্প হিসেবে একে টিকিয়ে রাখতে হলে- বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে যেতে হবে; দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দান করতে হবে; কর্মক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে; কর্মীদের বেতন বাড়াতে হবে এবং অংকটা অবশ্যই জাতীয় দারিদ্র্যসীমার চেয়ে বেশি হতে হবে; কর্মীদের বেতন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, কোনো দেশের অর্থব্যবস্থার একটা বড় ভরসা হলো সেখানকার শ্রমিকেরা। বিশেষ করে সে কারণেই শ্রমিক-মজদুরদের ততটা অন্তত সম্পন্ন করে তোলা অবশ্যই দরকার, যাতে তারা তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারে। আামদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করলে চলবে না। আসলে উন্নয়ন ঘটে একটি ভিশনকে সামনে রেখে। আর এই ভিশন মূলত দীর্ঘ মেয়াদী। তেমনি একটি ভিশনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিরুপন করা এবং সেই অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া জরুরী। তেজঁগাও কলেজ, ঢাকা থেকে
×