ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

রাজপুত ব্যাটেলিয়ন

প্রকাশিত: ১১:৫১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাজপুত ব্যাটেলিয়ন

১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল রবিবার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতে বাংলাদেশের মানুষ চরম অত্যাচার, শোষণ, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রকৃত স্বায়ত্তসাশনের লক্ষ্য অর্জনের মানসে গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য অবিচল প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বাংলার জনগণের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাকে ধ্বংস করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল জালেমরা বার বার ট্যাঙ্ক, কামান ও বোমারু বিমান ব্যবহার করে ব্যাপক নরহত্যা ও ধ্বংসের প্লাবনে ডুবিয়ে দিয়েছে। অত্যাচারী নরখাদক বর্বর পশুর দল নির্মমভাবে হত্যা করেছে লাখ লাখ নিরীহ নারী পুরুষ শিশুকে, লাখ লাখ বাড়ি ঘর ছাই করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দুর্জয় বিপ্লবী সংগ্রামে লিপ্ত। এই বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ দেবে। এ দিন ৮নং সেক্টরের ভোমরা নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা জেলার গোমতী নদীতে টহলরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণে পাকবাহিনীর ৪ জন সৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিফৌজের দুটি শক্তিশালী দল শালদার এবং জগন্নাথ দীঘির শত্রুঘাঁটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে চারজন পাকসেনাকে হত্যা করে। মুক্তিফৌজের এই পুনঃপুন আঘাতের ফলে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ফেনীর দক্ষিণে তাদের কামানের অবস্থান গড়ে তোলে। সেখান থেকে মুক্তিফৌজের অবস্থানের ওপর প্রচ- কামানের আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে মুক্তিফৌজের অবস্থান বেশ কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। পাকসেনারা তাদের কামানের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী মন্দাবাগ এলাকায় পাকহানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী আন্তর্জাতিক বর্ডারের কাছে সমরখন্দ এলাকায় একটি এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে ১৯ রাজপুত ব্যাটালিয়নের (ইন্ডিয়া) একটি অংশ মুক্তিফৌজের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। এ হামলায় একটি পাকিস্তানী পেট্রোল দলের ৫ জন আহত হয় এবং বাকিরা যুদ্ধ না করে পালিয়ে যায়। গতকাল পাকসেনারা সিরাজদীখান থানার আবদুস সালাম নামক মুক্তিফৌজের একজন গেরিলাকে গ্রেফতার করে তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রায় ৫০ জন গেরিলার একটি দল রাত সাড়ে আটটায় এই ক্যাম্পটির ওপর আক্রমণ চালায়। তারা প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর একজন পাকিস্তানী সুবেদার-মেজরসহ কিছুসংখ্যক পাকসেনা, পাক পুলিশ ও রাজাকারকে হতাহত করে আবদুস সালামকে উদ্ধার করে। ফেনীর ছাগলনাইয়ায় মুক্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ২ জন পাকসেনা নিহত ও অপর ২ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সাটানি, নারায়ণঘাট, আবাদের হাট ও কাকভাঙ্গায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ গোলাবিনিময়ের পর ১০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে ২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ার থানার উশখাইল গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা এক অভিনব কৌশলে মুসলিম লিগের একজন কুখ্যাত দালালকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে। আব্দুল হাকিম নামে উক্ত দালাল ইউনিয়ন কাউন্সিলের ও তথাকথিত শান্তি কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। এইদিন তার মেয়ের বিবাহের তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বর পক্ষের ছদ্মবেশে মিষ্টির হাঁড়িসহ তাঁর বাড়িতে হাজির হয়। বর পক্ষের অভ্যর্থনা দিতে ঘরের বাইরে আসলে মুক্তি সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর শেষে ঢাকা আসেন। তিনি বলেন, ইউরোপের বেতার, টিভি, সংবাদপত্রগুলো একই সুরে প্রচার করে চলেছে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অঘটন ঘটে গেছে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তাদের ক্ষমতা না দিয়ে সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনগণের দাবি নস্যাৎ করতে চায়। কারণ, নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানীদের মনোপুত হয়নি। তিনি বলেন, ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, যা ঘটবার ঘটেছে। এখন যারা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাদের নেতার সঙ্গে আপোস করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা দেশসমূহে এই ধারণা জন্মেছে যে, পাকিস্তানের নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাদের সঙ্গে আপোস না করলে বর্তমানে সমস্যার সমাধান হবে না। আমরা তাদের বলেছি নীতিগতভাবে আমরা এর বিরোধী নই। তবে নির্বাচনে যে দল জয়ী হয়েছে সেই দলের নেতা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন। এমন নেতৃত্বের সঙ্গে আপোস হতে পারে না। আজ তার সঙ্গে যদি কোন মীমাংসায় আসতে হয় তবে তা অখ- পাকিস্তানের ভিত্তিতে হতে হবে। এশিয়া সম্পর্কিত আলোচনা মার্ক টালি দ্বারা সম্পাদিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গতকাল পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে দুটি রিপোর্ট ঢাকায় বিবিসির সংবাদদাতা থেকে এসেছে। রোনাল্ড রবসন দাবি করেন যে মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ অংশের দখল রেখেছে। তবে ঢাকা এটি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে কয়েক শত মাইল ভ্রমণ করে আমি ব্যক্তিগতভাবে দখল করে রাখার তেমন কোন প্রমাণ পেলাম না। বিদ্রোহীরা হঠাৎ করে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে আবার দ্রুত সরে যায়। বর্ডার পার হওয়া অনেক সহজ। ১৭৮০ মাইলের মতো বিশাল সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের প্রবেশ ঠেকানো যে কোন সেনাবাহিনীর জন্য প্রায় অসম্ভব। গত মাসে নাশকতার কর্মকা- কম হয়েছে। বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকরা অনেক সেতু এবং অন্যান্য ঝুঁকিপ্রবণ পয়েন্ট পাহারা দিচ্ছে। ফলে নিয়মিত সৈন্য অন্যত্র পাহারায় থাকতে পারছে। পাকিস্তানী বাহিনীর অনেক হতাহত হচ্ছে। সীমান্তে শেলিংয়ের অন্যতম কারণ। তবে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যবেক্ষকদের মতে প্রতি মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০০০ জন হতাহত হচ্ছে। দ্বিতীয় রিপোর্টটি ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড করেছেন। তিনি ৩ টি ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থার ত্রাণ সমন্বয়ক এবং সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন। সেখানে কৃষি প্রজেক্টের কাজ বন্ধ আছে। তিনি গত রাতে একটি বিবিসি রেডিও প্রোগ্রাম এডাম রাফায়েলকে বলেছিলেন যে, তিনি ভিত এই কারণে যে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হবে। তিনি এই ফসল রোপণের সময় মাঠ বিনা চাষে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। পেট ফোলা বাচ্চারা পথের পাশে শুয়ে ছিল, ভিখারীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। তিনি কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যদি জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করতে চায় তাহলে তার জন্য মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। জানুয়ারিতে যে খাবার এসেছে তা এখনও বন্দরে পরে আছে। কিছুদিন আগে প্রায় ১০০টি জাতিসংঘ ট্রাক এসেছে কিন্তু তিনি চলে আসার আগ পর্যন্ত মাত্র ৩০ জন ড্রাইভার পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ বলেছে তারা খাদ্য বিতরণ করতে বিদ্যমান প্রশাসনের ওপর নির্ভর করবে কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড খুব সন্দিহান যে স্থানীয় প্রশাসন এই বিশাল সমস্যা কাঁধে নেবে কিনা। কারণ তারা গত কয়েক মাস ধরে অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘের চেষ্টা আমলাতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে। ৩ মাস চেষ্টা করেও তারা স্থানীয়ভাবে কাজ শুরু করতে পারেনি। ম্যাকডোনাল্ড প্রকৃতপক্ষে মনে করেন যে পরবর্তী কয়েক মাসে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সমস্যার কোন সমাধান আসলে হবে না। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কমিশনের রিপোর্টার মি. শ্যোন ও কনার ঢাকা সফর শেষে বলেছেন। ‘টিক্কা খানকে সরিয়ে ডা.মালিককে দখলীকৃত এলাকার গবর্নর নিয়োগের আসল উদ্দেশ্য বিদেশী সাহায্য বাগানো এবং বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করা।’ এ প্রসঙ্গে গার্ডিয়ান পত্রিকার মি. মার্টিন এডিনি বিবিসি থেকে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় অসামরিক গবর্র্নর নিয়োগ করা হলেও সামরিক তৎপরতার কোন পরিবর্তন ঘটবে না।’ অর্থাৎ ‘বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর পাক বর্বরতা ঠিকই চলবে এবং বেসামরিক গবর্নর ডা. মালিক সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল মাত্র।’ জন্মভূমি থেকে হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করে দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে আজ আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের দুর্বার প্রতিরোধের সম্মুখে টিকতে না পেরে দখলীকৃত এলাকায় জাতিসংঘের রিলিফ কর্মী নিয়োগের আরেকটি চক্রান্ত এঁটেছে জঙ্গীশাহী। কিন্তু আমরা জানি এই রিলিফকর্মী নিয়োগের আসল উদ্দেশ্য কি। জঙ্গীশাহী চাচ্ছে রিলিফ কর্মীর কথা বলে বাংলার বুভুক্ষু জনতাকে যেমন যুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা যাবে, তেমনি বিশ্বজনমতকে বাঙালীর দরদি সেজে ধোঁকা দেয়া যাবে। আমরা এও জানি, জাতিসংঘের এই তথাকথিত রিলিফ কর্মীদের বাংলাদেশে নিয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জঙ্গীশাহীর বর্বরতা-ও পৈশাচিকতায় সহায়তা করা। অর্থাৎ এদের ভূমিকা হবে দস্যুবাহিনীর দালালদের প্রতি আমাদের যে ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে এদের প্রতিও তাই করা হবে। এই প্রসঙ্গে বিবিসি থেকে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর একজন মুখপাত্র জাতিসংঘকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, তাদের রিলিফ কর্মীদের জঙ্গীশাহীর দালাল বলেই গণ্য করা হবে এবং তারা দালালদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থারই আওতায় পড়বে। বিবিসি থেকে আরও বলা হয়, এ ব্যাপারে জাতিসংঘ থেকে কোন মন্তব্য করা হয়নি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর মুখপাত্রের এই হুঁশিয়ারি জাতিসংঘকে বেশ খানিকটা ভাবিয়ে তুলেছে।’ ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বলা হয়, ‘ডেমোক্রেট দলের নেতা এ্যাডওয়ার্ড কেনেডির মতো রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর পার্সীও পাকিস্তান সরকারকে আমেরিকান সাহায্য দান বন্ধের দাবি জানান।’ বিবিসি রিপোর্টার মিঃ মাটিন বেল সম্প্রতি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের জন্য ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শরণার্থীদের অসীম দুঃখ-দুর্দশাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন-শুনেছেন পাক জঙ্গীশাহীর চরম বর্বরতা ও পৈশাচিকাতর অনেক করুণ কাহিনী। কিন্তু তিনি লাখ লাখ লাঞ্ছিত মানুষের শুধু একটা প্রমাণই দেখেছেন। শুনেছেন একই কথা। চাপ চাপ যন্ত্রণায় সে কথা চাপা পড়ে যায়নি বরং আরও বলিষ্ঠ হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। আর সে কথাটি হচ্ছে বাঙালীর অন্তর মথিত হৃদয়-সঙ্গীত ‘জয় বাংলা।’ লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×