ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং!

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং!

সত্যি সত্যিই এসব স্বজনের হঠাৎ একদিন নেই হয়ে যাওয়া কিছুতেই সইতে পারছি না। যখন দেখতে পাচ্ছি ছোট্ট শিশু, তাদের তরুণী মা, তাদের দাদা, দাদি অপেক্ষায় থাকছে তাদের স্বজনের জন্য যে হঠাৎ একদিন, ‘এখনই আসছি’ বলে আর কোনদিন ফিরে এলো না। তারপর সেই পরিবারটার ঐ তরুণের ফিরে আসার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা বছরের পর বছর পার হয়েও শেষ হলো না- এ কেমন ঘটনা! অপহরণ হওয়া মানুষগুলোর কাহিনী সভ্য, মানবিক সরকারের ভাবমূর্তি ম্লানই করছে। তার ওপরে, আমরা মা, বোন হিসেবে একজন স্বজন তরুণ হঠাৎ নেই হয়ে যাবে, সে আর কোনদিন ফিরে আসবে না অথবা সে কোন দুর্বৃত্তের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার পর তার মৃতিদেহটিও পাওয়া যাবে না- এ আমার মন মানে না। আমার প্রশ্ন হলো- অপহরণ হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে পরে আবার অনেকে ফিরে এসেছে। এটি একটি ক্লু, যে তাদেরকে কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কি ঘটেছিল তাদের সঙ্গে সে সব বিষয় তদন্ত করে পুলিশ এসব ঘটনার নেপথ্যের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে পারে এবং অপহরণের সম্ভাব্য অনেক কারণ, অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পারে। এটি এখনও করা হলো না কেন? আমরা র‌্যাব, পুলিশকে এমন অনেক আপাতদৃষ্টিতে ক্লুহীন হত্যা বা নিখোঁজ ব্যক্তির খুনের কারণ, খুনীদের বের করতে দেখেছি- যা পুলিশের উন্নত কৌশল ও প্রশিক্ষণের ফল হিসেবে দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। তাহলে, এসব চার পাঁচ বছর যাবত নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের সন্ধান এই একই পুলিশ, র‌্যাব বের করতে পারবে না কেন? এর আগে আমরা দেখেছি র‌্যাব-পুলিশের মধ্যে নিজেদের সব আইনের উর্ধে গণ্য করে নারায়ণগঞ্জে দিনে দুপুরে ভয়ঙ্কর সাত খুন সংঘটিত করেছে! এর অর্থ পুলিশ র‌্যাবে এমন ভয়ঙ্কর অপরাধীরাও রয়েছে! এর পাশাপাশি, ভয়ঙ্কর খুনী গু-াবাহিনীর পাড়ায় পাড়ায় মস্তানী করা, চাঁদাবাজি করা, অপহরণ করে চাঁদা চাওয়া বা খুন করে ফেলা, বালিকা-কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করা, ধর্ষণ করা, মাদকাসক্ত থাকা ইত্যাদি নানারকম অপরাধকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা গ্রুপগুলো রয়েছে যারা পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নানা কারণে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে অমানবিক হয়ে উঠেছে! দেখা যাচ্ছে- এদের হাতে খুন অপহরণের ঘটনা ঘটলে এরা খুব দ্রুতই ধরা পড়ে। এমন কি সম্প্রতি ফেনীর মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হুজুরের লালসার বলি নুসরাত হত্যা ও বরগুনার রিফাতকে প্রকাশ্যে দিবালোকে রাজপথে জনতার সামনেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের যে বার্তা দেয় তা একদিকে জঙ্গীদের পাশাপাশি আইনকে কব্জাকারী নারী লোলুপ ধর্ষক ও ভয়হীন সন্ত্রাসী দলের উত্থানকে জানান দেয়Ñ যারা আইনকে সরকারী দলের ক্ষমতাকে কব্জা করে পার পাবে- এ ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে অপরাধ সংঘটন করছে! এমন কি নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটনে দরিদ্র সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের সমর্থন, শক্তি জুগিয়েছে সেসব এলাকার প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি! এরপর তো বড় সমস্যা শহরের পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং! এরাও প্রায় একইরকম অপরাধ করছে এবং সবাই প্রায় মাদকাসক্ত এবং স্কুলের লেখাপড়ায় আগ্রহী নয়, বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে এরা সময় কাটায় না, কাটায় বখাটে বন্ধুদের সঙ্গে, মাদকের ডেরায় এবং কোন অপরাধ সংঘটনে জড়িয়ে পড়ে! আমার মনে হয়, শহরের নি¤œবিত্তের মানুষ, দোকানি, গৃহকর্মী, পোশাককর্মী, রিক্সা-সিএনজি চালক ইত্যাদি পেশার মানুষের এবং বস্তিবাসী শিশু-কিশোরদের শিশুকাল থেকে স্কুলে ভর্তি করা এবং অন্তত প্রাইমারীর আট ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, গান-বাজনা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের জন্য প্রত্যেক এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দু’জনকে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেয়া উচিত। কারণ, শিশু-কিশোরকালে মানুষ কেমন হবে, তার ভিত তৈরি হয়ে যায়, পরে ভাল ছেলেরা আর মন্দ পথে পা বাড়ায় না। অপরদিকে, কিশোর বয়সে পড়াশোনা, স্কুল ত্যাগ করে, মন্দ পথে পা বাড়ানো নানা অপরাধে অভ্যস্ত হয়ে পড়া কিশোর-যুবকদের সংশোধন অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে ভাল রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার একথা মনে রেখে আমাদের স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশের থানা, সুশীল সমাজের সদস্য এবং তরুণ প্রজন্মের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের জাতির কল্যাণে করা সম্ভব, সম্ভব দরিদ্রের সুবিধাবঞ্চিত ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত ও ভালো মানুষ হয়ে উঠতে সুযোগ করে দেয়া। অনেক আগে, কিশোর সংশোধনাগারকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলাম। স্কুল ফুটবল, ক্রিকেটের প্রতিযোগিতায় ওরা যেন অন্তর্ভুক্ত হয়, গান-নাচ-বাজনা শেখানো হয়, লেখাপড়ায় আবৃত্তি, গল্প শোনা, গল্প বানানো, শব্দের খেলা, ছবি জোড়া দেয়া, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করে ওদের আনন্দহীন পরিবেশকে আনন্দপূর্ণ করে তোলা যায় খুব সহজে। জানি না, কেন সরকারের মন্ত্রী, সচিব অথবা শিক্ষকদের এসব উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী হতে দেখি না। দুঃখ হয়, ওদেরকে দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েদের সুন্দর শৈশব-কৈশোর যা ওদের প্রাপ্য অধিকার, তা থেকে বঞ্চিত থাকতে দেখে! এর পরিণতি কারও জন্যই ভাল হবে না, সে তো আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। যাহোক, ফিরে আসি অপহরণ ও হত্যার প্রসঙ্গে। আমরা চাই- অতি সত্ব¡র সরকারপ্রধানের নির্দেশে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করে, দরকার হলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রতিটি অপহৃত ফিরে আসা ও না আসা ব্যক্তির অপহরণের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা হোক। কারণ, সরকারের নীরবতা এসব ঘটনায় কোন বিশেষ বাহিনী বা গোষ্ঠীকে আইনের উর্ধে রাখার ইঙ্গিত দেয় যা শেখ হাসিনার সরকারের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সরকার দোষী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতে, তার বিচার করতে বাধ্য এবং অপহরণের শিকার পরিবার সরকারের কাছে এর তদন্ত ও বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। আমরা তো জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনে নেই যে কয়েক হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক, জনগণ ও পরিবারের অগোচরে ফাঁসিতে বা বুলেটে গুম হয়ে গিয়েছিল! আমার মনে হয় ঐ ‘৭৬ থেকে ৮০ পর্যন্ত যত মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক, বিটিভি কর্মকর্তা, বিমান বাহিনীর প্রায় কয়েক যা তরুণ অফিসার যারা ঐ সময় ‘গুম’ বা নেই হয়ে গিয়েছিল কোন অপরাধ না করে, তাদের পরিবারের সদস্যরা মিলে একটি সংগঠন গড়ে তুলুক এবং এই নিহত ও হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের অবস্থার প্রকৃত ইতিহাস জেনে জিয়া ও তার মিত্র-খুনী সহায়তাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি জানাক সরকারের প্রতি। একজন আমলার ফেরি ধরতে দু’ঘণ্টা দেরি করার ফলে ফেরিতে থাকা এ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু পথযাত্রী কিশোর রোগীর এ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু হয়! ঢাকায় চিকিৎসা গ্রহণ তার পক্ষে সম্ভব হলো না আমলার নিজস্ব প্রয়োজনে ফেরি আটকে রাখার জন্য। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি দোষী সাব্যস্ত করেছে ফেরির তিনজন কর্মীকে কিন্তু যার জন্য ফেরি দু’ঘণ্টা বিলম্ব করল তার নাকি কোন দোষই নেই! এটি কোন ধরনের বিচার? আমরা মনে করি, ফেরি কেন, কার জন্য বিলম্ব করল সেটিও তো গণ্য হবে অপরাধ হিসেবে। এমনকি কোন মন্ত্রীও ফেরি বিলম্ব করার নির্দেশ দিতে পারে না। এই তদন্ত সুষ্ঠুভাবে করার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×