ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে মৃত্যু আর কতকাল?

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সড়কে মৃত্যু আর কতকাল?

কোন কোন শোক পাথরের চেয়ে ভারি। কোন কোন শোক পর্বতসমান কিংবা ততোধিক। তবে হতভাগিনী রুমানা সুলতানার শোক এসব কিছুই যেন ছাপিয়ে গেছে। বাক্যহারা শোকস্তব্ধ উত্তরা নিবাসী এই ভদ্র মহিলার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সম্ভবত কোথাও কোন ক্রন্দন কিংবা শোক অপেক্ষা করে নেই তার জন্য। মাত্র তিনদিন আগে সঙ্গীতশিল্পী ও পরিচালক স্বামী পারভেজ রব প্রাণ হারিয়েছেন বাসচাপায়। আর কুলখানি না হতেই বাবার মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় বাসচাপায় মারাত্মক আহত হলেন ছেলে ইয়াসির আলভি। নিয়তির পরিহাস হলো বাবা নিহত এবং ছেলে মারাত্মক আহত হলেন ভিক্টর ক্লাসিক কোম্পানির বাসেই। ইয়াসির আলভির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সঙ্গী মেহেদি হাসান নিহত হন ঘটনাস্থলেই। ইয়াসিরের অবস্থাও ভাল নয়, তার কোমরের হাড় ভেঙ্গে গেছে। কোনদিন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন কিনা সন্দেহ। আরও ট্র্যাজেডি হলো ইয়াসির তার বন্ধু মেহেদীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহন কোম্পানির বাসে দুর্ঘটনায় নিহত বাবার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলাপ করতে। গৃহবধূ রুমানা সুলতানার ভাষ্য, ‘এটা দুর্ঘটনা নয়, ইচ্ছাকৃত হত্যাকা-। ক্ষতিপূরণ নয়, আমি এর বিচার চাই।’ পরিহাস হলো কবে হবে এই বিচার কে জানে? রাজধানীসহ সারাদেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও ফিটনেস নবায়ন না করা গাড়ির সংখ্যা চার লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি। গত ২৪ জুন হাইকোর্টের এক নির্দেশের প্রেক্ষিতে আদালতে লিখিত এক প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দাখিল করে বিআরটিএর আইনজীবী। এর বাইরেও রয়েছে লাইসেন্সবিহীন অথবা ভুয়া বা জাল কাগজপত্রের যানবাহন। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ ফিটনেসবিহীন যানবাহন। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ক্ষয়ক্ষতি রোধসহ মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করার তোড়জোড় চলছে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় কমিটিও যেমন করা হয়েছে, তেমনি শতাধিক সিদ্ধান্তও হয়েছে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা রোধে। সড়কে চলমান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। স্কুলের কচি শিক্ষার্থীরাও সহপাঠীদের মৃত্যুর প্রতিবাদে নেমে এসেছিল রাজপথে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল নৈরাজ্য কতদূর বিস্তৃত হয়েছে পরিবহন খাতে। এসব নিরোধে কোথাও কেউ নেই, সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ২৮ গুণ বেশি। পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর ভাষ্যে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে ১২ হাজার ৫৪শ’ জন নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আহত ও পঙ্গুতে পরিণত হন অর্ধলক্ষাধিক। একটি দুর্ঘটনা মানে একটি পরিবারকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া। পঙ্গুত্বের অভিশাপে যারা ভোগে তারা পায় না ক্ষতিপূরণ। যানবাহন মালিকরা রাস্তায় চলাচলের অনুপযুক্ত যানবাহনকে রং-চং মাখিয়ে নতুনের আবরণ দিয়ে রাস্তায় নামায়, আর চালকদের আনাড়িপনায় প্রাণ যায় যাত্রীদের। এদেশে যানবাহন চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ নয়, উৎকোচই প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। যেনতেন প্রকারে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যায়। দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরতে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে কোন মূল্যে। জাতীয় মহাসড়কগুলোতে ১৫৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান রয়েছে। বেশকিছু স্থানে নিরাপত্তা চিহ্ন ফলক বসানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথাযথ মান বজায় রাখা হয়নি। রেলক্রসিংগুলো প্রায় অরক্ষিত। সড়কচিহ্ন ও মার্কিংসহ নানা ত্রুটি সর্বত্র। ১৮১ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে জাতীয় মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোয় সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো একটি। সড়ক-মহাসড়কে ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান, নসিমন, করিমন, লেগুনা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। সকল নৈরাজ্য, অব্যবস্থা, অনিয়মতান্ত্রিকতা দূর করে পরিবহন খাতকে ফিরিয়ে আনতে হবে সুশৃঙ্খল অবস্থায়। সড়ক-মহাসড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন ভুয়া চালক অপসারণ করে বিআরটিএকে রাখতে হবে সাফল্যের স্বাক্ষর।
×