ফিরোজ মান্না, চট্টগ্রাম থেকে ॥ রাঙ্গামাটির লংগদু থানার পাকুয়াখালী গ্রামের মানুষ আজও ভোলেনি ’৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের সেই গণহত্যার কথা। প্রতি বছর দিনটি এলেই সেখানে শোকাবহ স্মৃতি বেদনাবিধুর হয়ে তাদের তাড়িত করে। ওই দিনে ৩৫ নিরীহ বাঙালী কাঠুরিয়াকে বৈঠকের নামে ডেকে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছিল কথিত শান্তিবাহিনী। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল। কিন্তু ওই মামলায় কোন সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি গত ২৩ বছরেও। গণহত্যাকে কেন্দ্র করে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কমিটি তাদের প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যাদের সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তাদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের কথা দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। কিন্ত সে আশ্বাসও গুড়েবালিতে পরিণত হয়েছে। পাকুয়াখালীর মানুষের কাছে এখন আর কোন আশাই অবশিষ্ট নেই। তারা কেবল দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। এখন আর কেউ তাদের খবর নেয় না।
নৃশংস এই ঘটনার পর চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সুলতান মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছিল। ওই কমিটি ৩১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। কমিটির ওই প্রতিবেদনে, হত্যাকা-ের জন্য শান্তিবাহিনীকেই দায়ী করা হয়। বাঙালীদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নিয়ে গাছকাটার অনুমতি দিত শান্তিবাহিনী। কিন্ত ৯ সেপ্টে¤¦র চাঁদার টাকা কিছু কম দেয়ায় শান্তিবাহিনী ক্ষেপে গিয়ে এই নৃশংস হত্যাকা- ঘটায়। সেদিন নিরীহ ও নিরস্ত্র কাঠুরিয়ারা কোন প্রতিরোধই করতে পারেনি।
সেদিনের সেই নির্মম ঘটনার পর সরকারের কয়েক মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা এই গণহত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই আশ্বাসের অপেক্ষায় এখনও এলাকার মানুষ। কিন্ত বিচারের বাণী ওই গ্রামে আজও নীরবেই কেঁদে যাচ্ছে। সেদিনের নিষ্ঠুর গণহত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী শান্তিবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে আসা ইউনুস মিয়া। তার সঙ্গে গণহত্যা নিয়ে কথা হলো। তিনি পাকুয়াখালী গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন, ঘটনার ভয়াবহতা এখনও আমাকে তাড়া করে ফেরে। রাতে ঘুমাতে পারি না। হাত পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা-দিয়ে কুপিয়ে এবং বন্দুকের বেয়োনেট ও অন্যান্য দেশী অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল এই অসহায় মানুষগুলোকে। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তারা। যদিও শান্তিবাহিনীর হাতে আধুনিক অস্ত্র ছিল। কিন্ত তারা একটি গুলিও খরচ করেনি। বরং চাপাতি, কুড়াল ও লাঠি দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে ৩৫ নিরীহ মানুষকে। ৭ জনের লাশ তারা গুম করে ফেলে। বাকি ২৮ জনের লাশ স্তূপ করে রেখে চলে যায়। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছি, কিন্ত কোন প্রতিকার পাইনি। ঘটনার কথা সেনাবাহিনী পুলিশ সিআইডি সাংবাদিক আরও কতজনের কাছে বলেছি, কোন লাভ হয়নি। শান্তিবাহিনী স্থানীয় চাকমাদের ওপরেও অত্যাচার করত, ওদের কাছ থেকেও চাঁদা নিত। তবে সামান্য ভুল-ত্রুটি হলেই তাদের কথামত না চললেই মারধর করত। কতজন রে তো গুলি করে মেরে ফেলেছে। শান্তিবাহিনী এখনও একই রকম কাজ করে যাচ্ছে। চাঁদা তাদের দিতেই হচ্ছে, না দিলে তারা ধরে নিয়ে গহীন বনের ভেতর আটকে রাখে, নির্যাতন করে এমনকি মেরেও ফেলে। শান্তিবাহিনীর মতো আরও কয়েকটি উপজাতি গ্রুপ রয়েছে, তাদেরকেও চাঁদা দিতে হয়। এখানে নিরীহ বাঙালী ও পাহাড়ী কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
সেদিন যাদের হত্যা করা হয় তাদের নাম ইউনুস মিয়া ভুলে যায়নি। তাদের সবার নাম তিনি উল্লেখ করে বললেন, আমার চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটেছে কি করে আমি তাদের ভুলে যাব। যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা হলেন, ইসলাম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, আবদুল হক, ফজলুল হক, সুরুজ আলী, গিয়াস উদ্দিন, দুলাল মিয়া, হোসেন আলী, আহাম¥দ আলী, আহাদ আলী, আলাল উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন, আবুল কাশেম, হাদিস মিয়া, উমেদ আলী, আমির হোসেন, আবদুল খালেক, আসর আলী, আবদুল মিয়া, হামিদ, মোস্তফা, হেলাল, ওসমান গনি, রজব আলী, সেলিম, নজরুল ইসলাম, আবু বক্কর, আনসার আলী, আলাল উদ্দিন, ঈমান আলী, মজিবুর রহমান, আলী হোসেন, দুলাল মিয়া, হান্না মিয়া ও শরাফত উদ্দিন।