ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য দায়ী এডিস এ্যালবোপিক্টাস

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য দায়ী এডিস এ্যালবোপিক্টাস

নিখিল মানখিন ॥ ঢাকার বাইরে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশের অনেক জেলায় ইতোমধ্যে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। দুই সপ্তাহ আগে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের দাঁড়পাড়া গ্রামেই ৩৫ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। তারা কেউই দু’তিন মাসের মধ্যে ঢাকায় আসেননি। অবশেষে ঢাকার বাইরে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রকৃত কারণ বের করতে জরিপ পরিচালনা করছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ প্রতিরোধ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত এক মাস ধরে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে মারা যাওয়া ডেঙ্গু রোগীদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছে। সরকারী হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৫৭ হলেও বেসরকারী হিসাবে ২০০ জন। রবিবারও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ও খুলনায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১৮ বছর ধরে ডেঙ্গু প্রকোপ এলাকা বলতে রাজধানী ঢাকা শহরের নামই পরিচিত ছিল। কিন্তু চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা, ডেঙ্গু প্রকোপ এলাকা ও ডেঙ্গুর ধরনসব বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত। নতুন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এখনও প্রতিদিন যে হারে নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে এবং যে সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন থাকছে তা গত ১৮ বছরের যেকোন বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপের মাত্রার অনেক গুণ বেশি রয়ে গেছে। ঢাকা শহরের ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু গত এক মাস ধরে ঢাকা শহর ছাড়া বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং ঢাকা শহরের বেশিসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন থাকায় গ্রামাঞ্চলে এডিস মশার অবস্থান নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে। বিষয়টি ভালভাবে খুঁটিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, গত দু’সপ্তাহ আগে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের দাঁড়পাড়া গ্রামে ৩৫ জনের বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। আক্রান্তের মধ্যে অধিকাংশই কৃষক পরিবার। তারা কেউই দু’তিন মাসের মধ্যে ঢাকায় আসেননি। আক্রান্তদের অনেকে এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) সেলিম হোসেন ফরাজী সাংবাদিকদের বলেন, দাঁড়পাড়ায় আক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগই সেবা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আলাদাভাবে জানানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগে তিনি গ্রামটির ১০-১৫ জনের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতেন। একটি গ্রামের ছোট্ট একটি পাড়ায় এত রোগীর বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না বলে জানান সিভিল সার্জন। যশোর জেলার অন্তত চারটি গ্রামে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশার অস্তিত্ব পেয়েছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। যশোর শহরেও ৩৩টি স্থানে লার্ভা পেয়েছে তারা। ঢাকার বাইরে বর্তমানে এই জেলাতেই বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। পবিত্র ঈদ-উল-আজহার পরপর যশোরে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়ায় এডিস মশা নিয়ে জরিপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। কার্যালয়ের নিজস্ব কীটতত্ত্ববিদ এই জরিপে নেতৃত্ব দেন। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তারা যশোর পৌর এলাকা, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলায় জরিপ করে। যশোর শহর এলাকায় ১২০টি স্থান থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে জরিপ দল। এর মধ্যে ৩৩টি স্থানে তারা এডিস মশার লার্ভা পেয়েছিল। দিলীপ কুমার রায় বলেন, যশোরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বড় অংশ ছিল কেশবপুর, মনিরামপুর ও অভয়নগরের। এর মধ্যে কেশবপুর ও মনিরামপুরে ১০টি করে ২০টি স্থান থেকে পানি নিয়ে লার্ভা পরীক্ষা করা হয়। পানির আটটি নমুনায় লার্ভা পাওয়া যায়। তার মধ্যে চারটি নমুনা ছিল চারটি গ্রামের। কেশবপুরের দুটি গ্রাম ও মনিরামপুরের দুটি গ্রাম। রাজধানীর মতো গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ স্থায়ী রূপ নেয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধের বড় বড় কর্মসূচী রাজধানী কেন্দ্রিক হওয়ায় জেলা ও উপজেলা এলাকা অবহেলিত হয়ে আছে। এতদিন রাজধানী থেকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে জেলা ও উপজেলায় ডেঙ্গু রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু রাজধানীবাসীরা ফিরে আসার পরও ঢাকার বাইরে রাজধানীর তুলনায় বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। রাজধানীতে অবস্থান করে গ্রামে যাওয়া লোকজনই নয়, গ্রামাঞ্চলের লোকজনেরাও স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেকটা অরক্ষিত রয়ে গেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহর ব্যতীত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এডিস মশা নিধন কার্যক্রম একেবারেই নেই। ডেঙ্গু শনাক্তের ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে থাকলেও জটিল ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব সাধারণভাবে বলা যায় এডিস মশাই এ রোগটি ছড়াচ্ছে সর্বত্র। কিন্তু এডিস মশা এ রোগটি ছড়ালেও ঢাকার সঙ্গে ঢাকার বাইরের পার্থক্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সাধারণ এডিস (এডিস ইজিপ্টি) মশা নয়, ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর পেছনে এডিস এ্যালবোপিক্টাস নামে একটি প্রজাতি দায়ী। এডিস এ্যালবোপিক্টাস ও এডিস ইজিপ্টি ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর সঙ্গে এ দুই ধরনের মশা জড়িত। এদের মধ্যে ইজিপ্টি ঢাকা বা শহরাঞ্চলে বেশি থাকে। আর এর বাইরে গ্রামাঞ্চলে এডিস এ্যালবোপিক্টাস বেশি দেখা যায়। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কোন ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ২০১৬ সালে সারাদেশে ৭ হাজার ৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৩৭ জন ছিলেন ঢাকার বাইরের। ২০১৭ সালে ২ হাজার ৭৬৯ জনের মধ্যে ঢাকার বাইরে ১১৬ জন এবং ২০১৮ সালে সারাদেশে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক, কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এডিস এ্যালবোপিক্টাস যেহেতু মহামারী আকারে রোগ ছড়াতে পারে, সেহেতু এডিস এ্যালবোপিক্টাসই রোগ ছড়াচ্ছে বলে আমরা ধারণা করছি। তবে এখনও এর গবেষণালব্ধ তথ্য আমাদের কাছে নাই। এলবোপিক্টাস এডিস মশার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের মশা ঘরের ভেতরে নয় বরং বাইরে কামড়ায়। এডিস এলবোপিক্টাস মশার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ ধরনের মশা ঘরের ভেতরে না, বাইরে থাকে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে এডিস এ্যালবোপিক্টাস কোথায় জন্মায়। এডিস ইজিপ্টি’র মতো এটি যে কোন জায়গায় স্বচ্ছ পানি পেলেই বংশবৃদ্ধি করে না। এজন্য বিশেষ ধরনের পরিবেশের দরকার হয়। তিনি বলেন, এডিস এ্যালবোপিক্টাস যেখানে জন্মায় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে গাছের কোটর। এছাড়া রয়েছে বাঁশঝাড়। মূলত বাঁশ কাটার পর সেখানে থেকে যাওয়া গোঁড়ায় যে পানি জমে সেখানে এ্যালবোপিক্টাস মশা বেশি হয়। এছাড়া কলাগাছের দুটো পাতার মাঝখানে যে পানি জমে, কচু গাছের দুটো পাতার মাঝখানে যে পানি জমে, সেখানেও এই এ্যালবোপিক্টাস জন্মায়। এগুলোকে ন্যাচারাল কন্টেইনার বলা হয়। এ্যালবোপিক্টাসকে নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। যদি এটি আক্রান্ত করার ক্ষমতা বেশি পেয়ে যায় তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। ঢাকার বাইরে এবার এত বেশি ডেঙ্গু রোগী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী অপর মশা এডিস এ্যালবোপিকটাস গ্রামে বেশি থাকে। এতদিন গ্রামে মশা ছিল, কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল না। আক্রান্ত ব্যক্তি হচ্ছেন সোর্স অফ ইনফেকশন। মশা যখন আক্রান্ত মানুষকে কামড়েছে জীবাণুটা তার শরীরে ছড়িয়েছে। এইভাবে একসঙ্গে অনেক মানুষ যেহেতু গ্রামে গেছে। এ কারণে গ্রামে ডেঙ্গুর মাত্রাটা বেড়েছে। এবার ভারি বৃষ্টি না হওয়ায় মশা প্রজননের ‘সবচেয়ে উপযোগী’ পরিবেশ পেয়েছে বলে জানান তিনি।
×