ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৪ আসামি বেরিয়ে গেছে জামিনে

হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলার বিচার চার বছরেও হয়নি

প্রকাশিত: ১২:১১, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলার বিচার চার বছরেও হয়নি

শংকর কুমার দে ॥ পবিত্র আশুরা উপলক্ষে পুরান ঢাকার হোসেনী দালানের তাজিয়া মিছিল গ্রেনেড হামলায় হতাহতের ঘটনার চার বছর পরও বিচার হয়নি। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য স্থানান্তরের পরও বিচার হয়নি অদ্যাবদি। শুধু তাই নয়, আসামিদের মধ্যে ৪ জন জামিনে বের হয়ে গেছে। ৬ আসামি এখনও কারাগারে আছে। আর ৪৬ সাক্ষীর মধ্যে এখনও অনেকের সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ হয়নি। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে পবিত্র আশুরার মিছিলের প্রস্তুতিকালে তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালায় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গীরা। এতে দু’জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। দীর্ঘ চারবছর পরও বিচার না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে হতাহতের পরিবার। পুলিশের চার্জশীটে দেখা গেছে, বোমা হামলার ১২ দিন আগে জঙ্গীরা বৈঠকে মিলিত হয়। হামলার আগে ২০১৫ সালের ১৬ অক্টোবর আসামি মাসুদ, রুবেল, আশিক, হিরণ ও সোলায়মান ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে। পরে তারা অন্য জঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। আসামি আলবানি ওরফে শাহাদত ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা, আবদুল্লাহ বাকি ওরফে আলাউদ্দিন ওরফে নোমান, সাঈদ ওরফে হিরণ ওরফে কামাল ছিলেন হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। এই তিনজনই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মাসুদ রানাও পরিকল্পনায় অংশ নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী জঙ্গীরা হোসেনী দালানের কাছাকাছি ঘর ভাড়া করে। জেএমবির মোট ১৩ জঙ্গী এ ঘটনায় জড়িত ছিল। এদের মধ্যে জঙ্গী চাঁন মিয়া, মানিক, শাহজালাল, কবীর হোসেন ও সুমন প্রত্যক্ষভাবে হামলায় অংশ নেয়। অন্যরা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে। ওই হামলায় ১৩ জঙ্গী জড়িত ছিল। এদের মধ্যে ১০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযানের সময় তিন জঙ্গী ক্রসফায়ারে মারা যায়। চার্জশীটভুক্ত আসামিরা সবাই জেএমবির সদস্য। এরা হলেন-জাহিদ হাসান ওরফে রানা ওরফে মোসায়েব, আরমান, কবির হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আশিক, রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব, মাসুদ রানা, আবু সাঈদ সোলায়মান ওরফে সালমান, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ, শাহ জালাল, ওমর ফারুক ওরফে মানিক ও চাঁন মিয়া। আসামিদের শেষের চারজন জামিনে রয়েছে। অপর ছয় আসামি বর্তমানে কারাগারে। এছাড়া আসামিদের মধ্যে প্রথম তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে তারা জানায়, প্রথমে তাদের মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের শিয়াদের ওপর হামলার পরিকল্পনা ছিল। পরে হোসেনী দালানে হামলার পরিকল্পনা করে দ্রুত কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া নেয়। জঙ্গীদের পরিকল্পনা ছিল, হামলার দৃশ্য ভিডিও করার। কিন্তু আলোক স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হোজ্জা হোসেনী দালানের কবরস্থান থেকে পাঁচটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিল কবির হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আশিক। সে জেএমবির আত্মঘাতী হামলাকারী দলের সদস্য। ২০১৫ সালে ইমামবাড়ায় তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতির সময়ে রাত দেড়টার দিকে কবরস্থানের পশ্চিম গেটে তিন দফা বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় সানজু (১৬) নামে এক স্কুলছাত্র এবং জামাল হোসেন (৫০) নামে দুইজন নিহত হন। ওই ঘটনায় আয়াজ নামে এক যুবকের পা কেটে ফেলা হয়। আহত হয় প্রায় শতাধিক। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে তাজিয়া মিছিলে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গীরা বোমা হামলা চালানোর ঘটনার পর থানা থেকে তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। হামলার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ওই ঘটনায় আইএসের কোন যোগসূত্র নেই। তদন্ত শেষে ডিবি দক্ষিণের পুলিশ পরিদর্শক মোঃ শফিউদ্দিন শেখ ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ১০ জঙ্গীকে আসামি করে চার্জশীট অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর ওই বছরের অক্টোবরে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়। গতবছরের ৩১ মে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার উদ্দেশ্য ছিল মূলত ধর্মীয় বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। এতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এক শ্রেণী ফায়দা লুটার জন্য এ কাজে জঙ্গীদের ব্যবহার করে। এর বাইরে আপাতত কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কেননা মামলাটির তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশীট জমা পড়েছে। পুরান ঢাকায় মোঘল আমলে ১৭শ’ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয় হোসেনী দালান। এটি শিয়া সম্প্রদায়ের একটি উপাসনালয় ও কবরস্থান। ইমারতটি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পৌত্র ঈমাম হোসেনের কারবালা প্রান্তরে মৃত্যুবরণ স্মরণে নির্মিত। প্রতিবছর আশুরায় ইমামবাড়ার তাজিয়া মিছিল এখান থেকে শুরু হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির পূর্বে পুরান ঢাকার ঐহিত্যবাহী হোসেনী দালানে হামলা চালায় জেএমবি। হামলায় দুইজন নিহত হয়। ওই হামলার আগে জঙ্গীরা ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) করে হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। মামলাটি তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দেয়ায় বিচার কাজ চলছে। কারা, কি কারণে, কিভাবে হামলার পরিকল্পনা করে তার সব কিছু বেরিয়ে এসেছে গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে। গতবছরের মে মাসে ১০ জঙ্গীর বিরুদ্ধে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ। চার্জগঠনের পর ওই আদালতে মামলার বাদী চকবাজার থানার তৎকালীন এসআই মোঃ জালাল উদ্দিন সাক্ষ্য দেন। এরপর মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলি হয়। মামলাটি বদলি হওয়ার পর থেকে গতি পেয়েছে।
×