ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নভঙ্গ ভারতের বিজ্ঞানীদের

প্রকাশিত: ১১:৪০, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

স্বপ্নভঙ্গ ভারতের বিজ্ঞানীদের

চোখ মেলে চেয়েছিল প্রায় গোটা ভারত। মধ্যরাতে চাঁদের মাটিতে ভারতের বিক্রম দেখতে হাজির ছিলেন স্বয়ং দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইসরোর মিশন কন্ট্রোলের। একেবারে শেষ মুহূর্তে থমকে গেল ভারতের স্বপ্ন, পৃথিবী থেকে দীর্ঘ ৪৭ দিনের যাত্রা শেষে চাঁদের মাটি থেকে মাত্র ২.১ কিলোমিটার দূরে থাকতেই চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগ। এর মধ্য দিয়ে প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রোভার নামানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) বিজ্ঞানীদের নতুন অভিযানের উৎসাহ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমরা পিছিয়ে পড়িনি চাঁদে পৌঁছনোর জন্য আমাদের ইচ্ছাশক্তি আরও প্রবল হলো, সংকল্প আরও দৃঢ় হলো। চাঁদের ওই অংশটি এখনও মানুষের কাছে অজানা। এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়া। সেখানে জমাট বরফ আকারে পানি থাকার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছিলেন ভারতের চন্দ্রযান-১ অভিযান থেকে। ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারলে চন্দ্রযান-২ এর রোভার প্রজ্ঞান নতুন তথ্য পাঠাত। সেখান থেকে হয়ত জানা যাবে, চাঁদের বুকে কতটা পানি কী অবস্থায় আছে। ইসরোর বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২২ জুলাই মিশন শুরুর পর সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মহাকাশযান চন্দ্রযান-২ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেছিল গত ২০ আগস্ট। কক্ষপথে ঘুরতে থাকা চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার থেকে আলাদা হয়ে শনিবার প্রথম প্রহরে চাঁদের ৭০ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশে নিয়ন্ত্রিত অবতরণের কথা ছিল ল্যান্ডার বিক্রমের। তারপর উপযোগী পরিবেশে ল্যান্ডার বিক্রম থেকে বেরিয়ে আসত রোবটযান প্রজ্ঞান। চাঁদে নিয়ন্ত্রিত অবতরণের মিশন সফল হলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পর তালিকায় চতুর্থ দেশ হিসেবে নাম লেখাতে পারত ভারত। প্রজ্ঞান ঠিকমতো কাজ করলে ভারত হতো চন্দ্রপৃষ্ঠে রোভার চালাতে সফল হওয়া তৃতীয় দেশ। আর ভারত হতো চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে নিয়ন্ত্রিত অবতরণে সক্ষম হওয়া প্রথম দেশ। সেই মুহূর্তের সাক্ষী হতে পুরো ভারতবাসীর নজর ছিল টেলিভিশনে অথবা ইসরোর লাইভকাস্টে। আর চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডারের চাঁদে নামার দৃশ্য দেখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গালুরুর শ্রীহরিকোটায় ইসরোর সদর দফতরে। অরবিটার থেকে আলাদা হয়ে ল্যান্ডার বিক্রম অবতরণ শুরু করলে করতালিতে ফেটে পড়েছিল ইসরোর কন্ট্রোল রুম। কাঁচের দেয়ালের বাইরে দর্শক সারিতে বসে সেই দৃশ্য দেখছিলেন মোদি। সব ঠিক থাকলে ভারতীয় সময় রাত ১টা ৫৫ মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করার কথা ছিল বিক্রমের। তার এক মিনিট আগে চাঁদের ছবি পাঠানোর কথা ছিল নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। টান টান উত্তেজনা নিয়ে সেই চরম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সবাই। কিন্তু ইসরোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের স্ক্রিনে যে বিন্দু আর রেখায় বিক্রমের অবস্থান দেখানো হচ্ছিল, সেটা হঠাৎ থমকে গেল। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ল্যান্ডার বিক্রমের উচ্চতা তখন ২.১ কিলোমিটার। চন্দ্রযান-২ অভিযান কার্যত শেষ হয়ে গেল। ভারতের মহাকাশ গবেষণার পুরোধা বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নামে চন্দ্রযানের ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছিল বিক্রম। তার ভেতরে ছিল রোভার প্রজ্ঞান, যার লক্ষ্য ছিল চাঁদের মাটি থেকে মানুষের জন্য নতুন জ্ঞান আহরণ। ঠিক কী কারণে ল্যান্ডার থেকে সঙ্কেত আসা বন্ধ হয়ে গেল, শেষ পর্যন্ত বিক্রমের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে বিষয় এখনও জানতে পারেননি ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। শুক্রবার রাতে ইসরোর হেডকোয়ার্টারেই ছিলেন মোদি। পরিস্থিতি নিয়ে ভাষণে মোদি বলেন, আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, অভিযানের জন্য সার্বিক চেষ্টা করা হয়েছে। গোটা টিম নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে অনেকদূর এগিয়েছে। আজ আমাদের এই শিক্ষা আগামীদিনে আরও শক্ত ও আরও ভাল হতে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, আমরা সাফল্যের নতুন শিখরে পৌঁছাব। আমি আপনাদের বলতে চাই। সারা দেশ আপনাদের সঙ্গে আছে। আপনারা দেশের উন্নতিতে বড় অবদান রেখেছেন। চন্দ্রযান-২ ব্যর্থ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, কয়েক ঘণ্টা ধরে উদ্বেগে কাটিয়েছে দেশবাসী। সবাই আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রতি সমব্যথী। আজ চাঁদে পৌঁছনোর জেদ আমাদের আরও দৃঢ় হলো। আজ শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে তিনি এসব কথা বলেন। ইসরোর বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে মোদি বললেন, আমি আপনাদের কষ্টটা বুঝতে পারছি। আপনারা দেশকে গর্বিত করার জন্য সারা জীবন কাজ করছেন। তিনি বলেন, লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমরা দাঁড়াব না। আমরা আত্মবিশ্বাসী, সফল আমরা হবই। আমাদের কেউ রুখতে পারবে না। বিজ্ঞানে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। কাল নতুন ভোর হবে আর আরও উজ্জ্বল হবে। বিজ্ঞানীরা পাথর ভেঙ্গে পথ তৈরির মানুষ। তিনি আরও বলেন, হয়ত চন্দ্রযানের অভিযান সফল হয়নি কিন্তু দারুণ হয়েছে। তিনি বলেন, এই অভিযানের সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত ছিলেন। বাধা এসেছে হয়ত কিন্তু আমরা আমাদের রাস্তা থেকে সরব না। আজ হয়ত চাঁদে আমাদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আশা হারাব না। কাল রাত থেকে আপনারা কেউ ঘুমাননি। তাও আমার আপনাদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হলো। এ মিশন নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন মোদি। সফল হলে উৎসবের হাসিতেই হাসত ভারতবাসী। তবে শেষ পর্যন্ত এ মিশন ব্যর্থ হওয়ায় সুখের হাসি হাসতে পারলেন না মোদি। তবে গণমাধ্যমের সামনে দুঃখের হাসিই হাসলেন মোদি। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পূর্ব পরিকল্পনায় রাত ১টা ৩৮ মিনিটে শুরু হয় বিক্রমের অবতরণ প্রক্রিয়া। সেকেন্ডে ১.৮ কিলোমিটার থেকে যানের গতিবেগ কমিয়ে আনা শুরু হয় শূন্যে। সেই লক্ষ্যে শুরু হয় হার্ড ব্রেকিং। নিখুঁত হার্ড ব্রেকিং পর্বের পর ফাইন ব্রেকিং পর্ব শুরু হতেই দেখা দেয় বিপর্যয়। সেই পর্যায়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইসরোর কন্ট্রোল সেন্টারের সঙ্গে যাবতীয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যানটির। ইসরোর প্রধান শিবান বলেন, বিক্রম ল্যান্ডার ছিল পরিকল্পিত এবং ২.১ কিলোমিটার পর্যন্ত স্বাভাবিক লাগছিল। পরবর্তীকালে, পৃষ্ঠের সঙ্গে ল্যান্ডারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান নামাতে না পারলেও ভারত ও তার বিজ্ঞানীদের নিয়ে ভুটানও গর্বিত বলে ট্যুইট করেন শেরিং।
×