ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দৈনিক খরচ গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা

বেসরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যয়বহুল

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 বেসরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা  ব্যয়বহুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হলেই বড় অঙ্কের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। এই চিকিৎসা ব্যয় সরকারী হাসপাতালে সহনীয় হলেও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে গড়ে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ডেঙ্গু রোগীদের অভিযোগ, সরকারী হাসপাতালেও দামী ওষুধ ও ইনজেকশন বাইরে থেকে কিনতে হয় এবং বিভিন্ন টেস্ট বাইরে করাতে হয়। আর বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ের যেন শেষ নেই। রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে রক্ত দিতে হয়। তার ওপর প্রতিদিন নানারকম পরীক্ষা চলছে। ইনজেকশন লাগলেই প্রতিটির পেছনে গুনতে হয় সাত হাজার টাকা। আর রোগীশয্যার দৈনিক খরচ তো আছেই। সরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হতে ১০ টাকা ভর্তি ফি ও ভর্তির ফরম ফি ১৫ টাকা। অর্থাৎ মোট ২৫ টাকা। আমরা প্রথমে শনাক্ত করার জন্য রোগীর রক্তের ‘এনএস১’ পরীক্ষা করি। এটা সব সরকারী হাসপাতালেই বিনামূল্যে হয়। রোগী যদি পাঁচ-ছয় দিনের জ্বর নিয়ে আসে তাহলে রক্তের ‘এ্যান্টিবডি’ পরীক্ষা করি। আর রক্তের প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য ‘সিবিসি’ বা ‘টোটাল ব্লাড কাউন্ট’ করি। এ সবই বিনামূল্যে করা হয়। বাইরে থেকে করালে ‘সিবিসি’র জন্য খুব বেশি হলে ২০০ ও ‘এ্যান্টিবডি’র জন্য ৮০০-১২০০ টাকা খরচ হয়। এ্যালবুটিক ইনজেকশনের বিষয়ে ডাঃ উত্তম বড়ুয়া বলেন, সাধারণত যেসব ডেঙ্গু রোগী খুব জটিল, ডেঙ্গুর পাশাপাশি ডায়াবেটিস, কিডনি বা অন্য রোগী আছে, তাদের ক্ষেত্রেই শুধু এই ইনজেকশন লাগে। সব রোগীর ক্ষেত্রে এই ইনজেকশন লাগে না। বাজারে এই ইনজেকশন সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। তিনি বেসরকারী হাসপাতালে সরকারী গাইডলাইন মানা হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক ব্যয় হচ্ছে গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিন একটা ‘এ্যালবুটিক ইনজেকশন’ কিনতে হচ্ছে সাত হাজার টাকা করে। জার্মান ও আমেরিকার তৈরি এই ইনজেকশন দেয়া হয় শরীরের রক্তের প্রোটিন ‘এ্যালবুনিল’ বেশি কমে গেলে। এ ধরনের রোগী জটিল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এছাড়া প্রতিবার রক্তের ক্রসম্যাচিং করতে ব্যয় হচ্ছে ১৫০০ টাকা করে। এর বাইরে দৈনিক বেড ভাড়া ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় তো রয়েছেই। এ ব্যয় সরকারী হাসপাতালের তুলনায় ৫-৭ গুণ বেশি। অর্থাৎ একজন ডেঙ্গু রোগীর সরকারী হাসপাতালে ব্যয় হচ্ছে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা। অবশ্য রোগীর ধরন অনুপাতে চিকিৎসা দিতে গিয়েই ব্যয় হয়ত কিছুটা বাড়ছে বললেন বেসরকারী সেন্ট্রাল হাসপাতালের উপপরিচালক ডাঃ এ টি এম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে ইনজেকশনের (এ্যালবুটিক) কথা বলা হচ্ছে, সেটা জটিল ডেঙ্গু রোগীদের দেয়া হচ্ছে। যেসব রোগীর রক্তের ‘এ্যালবুনিল’ নামে এক ধরনের প্রোটিন মাত্রাতিরিক্ত হারে কমে যায়, তাদের রক্তের প্রোটিন বাড়াতে এটা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া বাকি সবকিছুই হচ্ছে নিয়মের মধ্যে। এই চিকিৎসক আরও বলেন, এবার শুধু রোগীর সংখ্যায়ই বেশি না। ডেঙ্গু আক্রান্ত যত রোগী আসছে এদের সবার প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, সবাই শকে চলে যাচ্ছে। আগে সামান্য চিকিৎসায় ডেঙ্গু ভাল হয়ে যেত। এবার সবারই রক্ত লাগছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বর হলে গাফিলতি না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, ক্ল্যাসিক ডেঙ্গু রোগীদের দৈনিক ২-৩ লিটার সাধারণ ওরস্যালাইন দেয়া হচ্ছে। তরল খেতে হচ্ছে ৩ লিটার। ফল ও ফলের রস খেতে হয়। ওষুধের মধ্যে প্যারাসিটামল ও বমি কমার জন্য একটা ওষুধ সেবন করতে হয়। পানি শূন্যতা দেখা দিলে শিরায় আইভি স্যালাইন দিতে হয়। এটার দাম এক থেকে দেড় শ’ টাকা। তিনি আরও জানান, ডেঙ্গু রোগীদের রক্ত কিনতে হয় না, শুধু বদল করতে হয়। সেজন্য রক্তের ক্রসম্যাচিং করতে ব্যয় হয় ১৫০০-২০০০ টাকা বলে জানান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়েছে, চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৭৯৩। সারাদেশে শুক্রবার পর্যন্ত মোট রোগীর ৯৬ শতাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। তবে ঢাকার বাইরে নতুন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেশি রয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় নতুন ভর্তি ৩২৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৬৮ জন । সারাদেশে বর্তমানে ভর্তি ডেঙ্গু ও সন্দেহজনক ডেঙ্গু রোগীর সর্বমোট সংখ্যা ৩,৩৩৭ জন। ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৭০৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১,৬৩৩ জন। এ বছর জানুয়ারি থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ভর্তি ও ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ৭৫১৪৬ ও ৭১৬১৭ জন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ১৯২টি মৃত্যুর তথ্য প্রেরিত হয়েছে। তন্মধ্যে আইইডিসিআর ৯৬টি মৃত্যু পর্যালোচনা সমাপ্ত করে ৫৭টি মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত বলে নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। বেসরকারী হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা দেড় শতাধিক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম আরও জানায়, বর্তমানে ঢাকা শহর ছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় ৩৫১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলায় ৮৬ জন, চট্টগ্রামের ১১ জেলায় ২৮০ জন, খুলনা বিভাগে ৪৯৬ জন, রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলায় ১৩৮ জন, রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় ৫৪ জন, বরিশালের ছয়টি জেলায় ১৯৯ জন এবং সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় ২৯ চিকিৎসাধীন রয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, ঢাকা শহরে অবস্থিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৪০ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৩৫ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৬৭ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৩২ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৮ জন, রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালে ২৫ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২১১ জন, বিজিবি হাসপাতাল, পিলখানা, ঢাকায় চারজন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৫০ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১১৬ জন, কুয়েট বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নয়জন ও পঙ্গু হাসপাতালে পাঁচজন নতুন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে।
×