ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশ্যে বরিশালের জনপ্রতিনিধি নেপথ্যে ‘রয়্যাল চিটিং ডিপার্টমেন্টের’ মূল হোতা

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রকাশ্যে বরিশালের জনপ্রতিনিধি নেপথ্যে ‘রয়্যাল চিটিং ডিপার্টমেন্টের’ মূল হোতা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ঢাকায় সক্রিয় ‘রয়্যাল চিটিং ডিপার্টমেন্ট’ (আরসিডি) নামে পরিচিত প্রতারক চক্রের সক্রিয় তিন সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে মূলহোতাদের নাম। ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ পেতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া প্রতারক চক্রের মূলহোতা বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সিকদার ও একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন রেজার নাম প্রকাশের পর তাদের নিজ এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। মুখ খুলতে শুরু করেছেন দুই চেয়ারম্যান ও তাদের সহযোগীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি থাকা ভুক্তভোগীরা। হত্যা, মাদকসহ একাধিক মামলার পর এবার ভয়ঙ্কর প্রতারণার ঘটনায় অনতিবিলম্বে অভিযুক্ত ওই দুই চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন মুলাদী উপজেলাবাসী। পুলিশের অভিযানে গ্রেফতারের পর কারাগারে থাকা ‘রয়্যাল চিটিং ডিপার্টমেন্ট’ নামের প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্যরা হলো আলাউদ্দিন হাওলাদার, আজাদ হোসেন কলিম ও শফিউল ইসলাম। তাদের সকলের বাড়ি মুলাদী উপজেলায়। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে উল্লেখিত দুই চেয়ারম্যান তাদের প্রত্যেককে কাজপ্রতি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এজন্য তারা ওই দুই চেয়ারম্যানের কথামতো প্রতারণার সময় কেউ জমির মালিক আবার কেউ শিল্পপতির ম্যানেজার সেজে কথা বলতেন। আগে তারা মুলাদীতে কেউ ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন, আবার কেউ মাছের ব্যবসা করতেন। মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সিকদার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন রেজা একসময় বিএনপি করতেন। তাদের প্রতারণার কায়দা ও কৌশল রাজকীয় হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কাছে তারা ‘রয়্যাল চিটিং ডিপার্টমেন্ট’ (আরসিডি) নামে পরিচিত। শহিদুল ও রেজার নেতৃত্বে ঢাকায় হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। তাদের টার্গেট রাজধানীর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও অভিজাত এলাকার বাড়িওয়ালা। তাদের কাছ থেকে অভিনব প্রতারণার ফাঁদ পেতে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। শেরে বাংলানগর ও পল্লবীসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন থানায় তাদের নামে প্রতারণা, মাদক এমনকি হত্যার মামলাও রয়েছে। সম্প্রতি গুলশানের এক বাড়িওয়ালা ও স্বনামধন্য গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মোজাহিদুল ইসলাম প্রদীপের কাছ থেকে জমি বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে নগদ ৭২ লাখ টাকা এবং ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক হাতিয়ে নিয়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা গা ঢাকা দেয়। গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মোজাহিদুল ইসলাম প্রদীপ বলেন, প্রতারকরা তার কাছ থেকে নগদ অর্থ ও চেক হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেয়ার পর গত (২৪ আগস্ট) ওই প্রতারক চক্রের এক সদস্য আমাকে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করে মতিঝিলে আসার জন্য বলে। বিষয়টি আমি (প্রদীপ) মতিঝিল থানা পুলিশকে অবহিত করার পর পূর্বাণী হোটেলের সামনে থেকে উল্লেখিত তিন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকার মতিঝিল জোনের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঢাকার অভিজাত এলাকার বাড়িওয়ালার কিংবা শিল্পপতিদের টার্গেট করে প্রতারক চক্রের সদস্যরা কেউ নিজেকে বিদেশ ফেরত বড় শিল্পোদ্যোক্তা, কেউ কথিত শিল্পপতির ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে কৌশলে বিশ্বস্ততা অর্জন করে জমি বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কয়েক বছর ধরে চক্রটি সক্রিয় রয়েছে। একাধিকবার কয়েকজন সদস্য গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে তারা ভিন্নকৌশলে প্রতারণা করে আসছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, চক্রের মূলহোতা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম একাধিক মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে। এর মধ্যে একটি নম্বর সে সবসময় ব্যবহার করে। অন্যগুলো সবসময় বহন করে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রযুক্তিকে ফাঁকি দেয়ার জন্য বিশেষ নম্বর সে কখনও এলাকায় নেয় না। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে তাদের দলের মূলহোতা শহিদুল ইসলাম সিকদার ও মহসিন রেজা। এছাড়াও ওই চক্রের সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে রয়েছে-মাসুদ আলম, আব্দুল খলিল ও জলিল। তাদের সবার বাড়ি মুলাদী উপজেলায়। ভয়ঙ্কর এ চক্রের মূলহোতাসহ অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান চলছে। মুলাদী উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতারা জানান, ২০১৮ সালের ৯ মার্চ রাতে একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিরোধের জের ধরে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা প্রকাশ্যে নাজিরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল বাশার প্রিন্সকে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার দুদিন পর আড়িয়াল খা নদী থেকে পুলিশ প্রিন্সের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও রহস্যজনক কারণে আইনের ফাঁক-ফোকর পেরিয়ে জামিনে বের হয়ে আসে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম। এছাড়াও ইউপি চেয়ারম্যান ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে জাল টাকা এবং মাদক ব্যবসার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ সম্পর্কে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সব সময় গ্রামে থাকি। ঢাকাতো দূরের কথা কখনও বরিশাল শহরেও যাই না। তিনি আরও বলেন, কখনও অসৎ পন্থা অবলম্বন করিনি। ষড়যন্ত্র করে আমাকে হত্যাসহ অন্যান্য মামলায় আসামি করা হয়েছে।
×