ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দাগি বাবুই

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দাগি বাবুই

এই রিমি আপু, ওঠো না, দেখো ভোর হয়ে গেছে।’ আলতো করে চোখ মেলে তাকায় রিমি। তার মামাত বোন টুনি তাকে ডাকছে। টুনিকে দেখে প্রথমে অবাক হয় রিমি। আরে টুনি এলো কোথা থেকে! পরে মনে পড়ে যায় রিমির। গত রাতে মায়ের সঙ্গে সে গ্রামে এসেছে কয়েক দিনের জন্য। ‘কি হয়েছে টুনি, ডাকছ কেন?’ খাটে উঠে বসতে বসতে টুনিকে প্রশ্ন করে রিমি। টুনি বলে, ‘এসো, বাইরে এসো, দেখবে চলো।’ এই ভোরবেলা টুনি কি দেখাবে তা বুঝে পায়না রিমি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ঘর থেকে বের হয়, কলের ঠান্ডা পানি দেয় চোখেমুখে। রিমি ঢাকা শহরে নামকরা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। আর টুনি গ্রামের একটা প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। টুনি রিমিকে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। তার হাতে ছোট্ট একটা বেতের ঝুড়ি। কেমন যেন শীত শীত করে রিমির। অবাক চোখে চেয়ে গ্রামের ভোর দেখে সে। রাখাল গরুর পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে, মেঠোপথের দু’ধারে বুনো ঝাড়, কোথাও আবার সোনালি ধানের ক্ষেত। পাখিদের কিচিরমিচির, বাতাসে মিষ্টি ফুলের গন্ধ। সব মিলিয়ে যেন এক টুকরো ছবি। ইস্কাটন রোডের অভিজাত এ্যাপার্টমেন্টে বেড়ে ওঠা রিমির কখনই দেখা হয়নি এমন দৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে মাথা উঁচু করা বিশাল এক গাছের সামনে এসে পড়ে রিমি আর টুনি। গাছ ভরা ছোট ছোট সাদা ফুল। এক পলক দেখে রিমির মনে হয় আকাশের সব তারা যেন নেমে এসেছে এই গাছে। টুনিকে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কি গাছ টুনি?’ ‘এটাতো শিউলি ফুলের গাছ। ওই যে দেখো মাটিতে শিউলি ফুল ঝরে পরে আছে।’ গাছের দিকে এগোয় রিমি আর টুনি। একে একে কুড়িয়ে নেয় ছোট্ট সাদা শিউলি ফুল। কি সুন্দর ফুলগুলো! ছোট্ট ছোট্ট সাদা পাপড়ি, মাঝখানে কমলা রঙের বৃন্ত। শিউলি ফুলগুলো দেখতে যেমন সুন্দর গন্ধটাও তেমনি মন মাতানো। টুনির ঝুড়িটা ফুলে ভর্তি হয়ে যায়। রিমি বলে, ‘চলো বাড়ি ফিরে যাই টুনি। মা বকা দেবে।’ টুনি অবশ্য নাছোড়বান্দা। বলে, ‘এখন যাব না, আগে তোমাকে নদীটা দেখাই, তারপর।’ রিমি আর কি করবে। সে হাঁটতে শুরু করে টুনির সঙ্গে। নদীর তীরে পৌঁছে আরও অবাক হয় রিমি। নদীর তীর জুড়ে সাদা সাদা কাশফুল। টুনি বলে, ‘এমন কাশবন দেখেছ আগে?’ রিমি ছড়ার বইগুলোতে সে কাশফুলের কথা পড়েছে। স্কুলের ড্রইং পরীক্ষাতে নদীর তীরে কাশবনের ছবি এঁকেছে। কিন্তু কখনও চোখে দেখিনি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে কাশফুলগুলোকে। ওমা কি নরম! ঠিক যেন তুলোর মতন। রিমির মনে হয় সে যেন মাটিতে নয় আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাশবনটা যেন আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো। আর তার মধ্যে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে রিমি। হঠাৎ করে কিছু একটা এসে পড়ে রিমির গায়ে। সে ভয়ে আঁতকে ওঠে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা পাখি পড়ে আছে। পাখিটার মাথার চাঁদিটা গাঢ় হলুদ রঙের। ডানা পালকগুলো হালকা বাদামী রঙের, তার ওপর গাঢ় বাদামি রঙের দাগ। পাখিটার একটা ডানায় জখমের টাটকা দাগ। টুনিকে ডেকে পাখিটা দেখায় রিমি। টুনি বলে, ‘আরে এটা তো দাগি বাবুই। এই কাশবনেই কোথাও বাসা বেঁধেছে। নিশ্চয়ই কোন বড় পাখি এই ছোট্ট পাখিটাকে তাড়া করেছিল।’ রিমি বলে, ‘বাবুই পাখি তো তাল গাছে বাসা বাঁধে? কাশবনে কেন বাসা বাঁধতে যাবে?’ রিমির কথা শুনে হাসে টুনি। বলে, ‘এটাও এক ধরনের বাবুই পাখি। তবে তালগাছে যে বাবুই পাখি বাসা বাঁধে তার থেকে ভিন্ন। দাগি বাবুই পাখি নদীর ধারে, কাশবনে কিংবা হোগলার বনের বাসা বাঁধে। কি কষ্টই না পাচ্ছে পাখিটা!’ পাখিটাকে দেখে খুব মায়া হয় রিমি আর টুনির। পাখিটাকে বাড়িতে নিয়ে যায় ওরা। বাড়িতে ঢুকে রিমি দেখে উঠোনে বসে মা, বড় মামা, নানু ভাই চা খেতে খেতে গল্প করছেন। রিমিকে দেখে মা বলেন, ‘টুনির সঙ্গে ফুল তুলতে গিয়েছিলিস বুঝি? তা হাতে ওটা কি?’ রিমি এগিয়ে গিয়ে আহত পাখিটাকে দেখায়। পাখিটাকে দেখে নানু ভাই বলেন, ‘ভালমতো জখম হয়েছে বেচারা। ওর যত্ন নিতে হবে। রিমি টুনি তোমরা পারবে পাখিটাকে দেখে রাখতে?’ উৎসাহে মাথা নাড়ে টুনি আর রিমি। ছোট মামা পাখিটার জখম পাখাটা পরিষ্কার করে দিয়ে একটা পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দেন। মামির কাছ থেকে শাড়ির একটা বাক্স চেয়ে আনে রিমি আর টুনি। খড় ও ঘাস-পাতা দিয়ে একটা আরামদায়ক বাসা বানায় আহত পাখিটার জন্য। ওরা পাখিটার নাম রাখে পিপি। দু’জনে মিলে খুব যত্ন করে পিপির। সময় মতো খাবার খাওয়ায়, আলতো করে আদর করে। প্রথম প্রথম পিপি খুব ছটফট করত, কিন্তু এখন বোধহয় পিপিও ওদের ভালবাসাটা বুঝে গেছে। দিন তিনেক পরে অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে পিপি। ডানার জখমটাও সেরে উঠেছে। রিমির খুব ইচ্ছা পিপিকে সে নিজের কাছে রেখে দেবে। খাঁচায় পুরে নিয়ে যাবে ঢাকায়। অন্যদিকে টুনির ইচ্ছা পিপিকে নিজের কাছে রাখার। একদিন দুপুরবেলা রিমি আর টুনিকে ডেকে নিলেন নানু ভাই। বললেন, ‘আচ্ছা রিমি টুনি আমি যদি তোমাদের খাঁচায় পুরে রাখি কেমন লাগবে তোমাদের?’ রিমি টুনি দু’জনে আঁতকে উঠে বলে, ‘আমাদের একদম ভাল লাগবে না নানু ভাই, খুব কষ্ট হবে।’ নানু ভাই বললেন, ‘পিপিকেও যদি তোমরা বেশি দিন আটকে রাখ তাহলে ওর খুব কষ্ট হবে। পিপি এখন সুস্থ। ওর এখন নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।’ রিমি টুনি দু’জনই নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। সেদিন বিকেল বেলায় তারা আবার নানু ভাইয়ের সঙ্গে নদীর তীরে কাশবনে যায়। পিপিকে একটু আদর করে উড়িয়ে দেয় আকাশে। তার পর রিমি আর টুনি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। আর ছোট্ট দাগি বাবুই উড়ে চলে যায় আকাশের পানে। স্নাতক, ২য় বর্ষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×