ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিচিত্র তথ্য ;###;হুমায়ূন শফিক

মশার কামড়ে বীরের মৃত্যু!

প্রকাশিত: ১৩:০২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মশার কামড়ে বীরের মৃত্যু!

এক সময় পৃথিবীতে এমন কোন রোগ ছিল না, যা ম্যালেরিয়ার মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল! একটি বিষয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেতে যেখানে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেখানে ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য পাঁচ পাঁচবার নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে! মশাবাহিত এই রোগ দুনিয়ায় এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল। আজ পর্যন্ত এই গ্রহের অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছে মশার কারণে। ফলে আপনি মশাকে ‘সিরিয়াল কিলার’ও বলতে পারেন। ইতিহাসের অধ্যাপক টিমোথি সি.ওয়াইনগার্ড ‘দ্য মসকুইটো : এ্যা হিউম্যান হিস্ট্রি অব আওয়ার ডেডলিয়েস্ট প্রিডেটর’ বইয়ে এই উড়ন্ত পতঙ্গকে ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূত’ বলেছেন। ওয়াইনগার্ড দেখিয়েছেন, মানব ইতিহাসে অন্য যে কোন ঘটনার চেয়ে মশা কীভাবে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যা করেছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যে দেখা যায়, এ পর্যন্ত বিশ্বে যত লোকের মৃত্যু হয়েছে তার অর্ধেকেরই হয়েছে মশার কামড়ে। অন্য কথায়, মশা প্রায় ৫২ বিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছে। মশার কারণে মানুষের বিশ্বে বার্ষিক গড় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। অন্যদিকে হাঙ্গরের হামলায় নিহতের সংখ্যা মাত্র ১০ জন। এই পতঙ্গগুলো ১৫টি ভয়ঙ্কর রোগ লালন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুটি রোগ হচ্ছে ম্যালেরিয়া ও হলুদ জ্বর। মশা নিয়ে ফিকশনও কম হয়নি। যদিও কথাসাহিত্যিকেরা বেশিরভাগ সময়ই মশাকে নিয়ে জোকস বা হালকা রসিকতাপূর্ণ লেখা লিখেছেন। তবে বিজ্ঞানীরা ব্যতিক্রম। তারা মশাকে গুরুত্ব দিয়েছেন যতœ নিয়ে। যাই হোক, ম্যালেরিয়ার উৎস সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের অনেক আগের সময়ে চলে যেতে হবে; হয়ত জুরাসিক পার্কের সময়ে। এই জ্বরের বৈশিষ্ট্য হলো প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ঠা-া হয়ে কাঁপুনি শুরু হওয়া এবং প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর বিশালাকৃতির প্লীহার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ১৫৭০ সালে প্যাপিরাসে। এই অসুখের খোঁজ হয়ত আরও অনেক আগেই কেউ না কেউ পেয়েছিল। জানা গেছে, হারকিউলিস এবং হাইড্রার সময়েও লোকজন ম্যালেরিয়ার ভয়ে অতিষ্ঠ থাকত। ম্যালেরিয়া রোগের মাধ্যমে মশা মানব ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। মশার হাত থেকে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সৈন্যবাহিনীও রক্ষা পায়নি। যেমন এই ম্যালেরিয়াই থামিয়ে দিয়েছিল চেঙ্গিস খানের পশ্চিমমুখী লুণ্ঠন। মশা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পতন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ওয়াইনগার্ড বলেন, আলেকজান্ডার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা পূর্ব ও পশ্চিমকে একত্রিত করতে সক্ষম হওয়ার আগেই তার প্রাণ কেড়ে নেয়। এই ম্যালেরিয়াবাহী মশা তার জীবনাবসান না ঘটালে সকল ইঙ্গিত এটাই নির্দেশ করে যে, তিনি দূরপ্রাচ্য অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এটা ঘটলে ইতিহাস ও মানব সভ্যতার গতিপথ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছত যেখানে আধুনিক সমাজ আক্ষরিকভাবে অ-শনাক্তযোগ্য হতো। চেঙ্গিস খান ও তার মঙ্গোল সেনাবাহিনীর অগ্রাভিযান বন্ধেও ম্যালেরিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওয়াইনগার্ড বলেন, ম্যালেরিয়া পাশ্চাত্যকে মঙ্গোল বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ম্যালেরিয়া তার শক্তির ব্যাপক প্রয়োগ ঘটায় এবং মঙ্গোলদের বিজয় থামিয়ে দিয়ে তাদের ইউরোপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। রাজা তুতেনখামেন, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, চেঙ্গিস খানÑ ধারণা করা হয় তারা প্রত্যেকেই ম্যালেরিয়াতে মারা যান। প্রাচীন মিসরে এক সময় এই রোগ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা ত্বকে রসুন মাখানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে মশা রসুনের গন্ধে দূরে থাকে। হিপোক্রেটিস (৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্ব) তার বইয়ে পিরিয়ডিক জ্বরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এক রকম জ্বরে তৃতীয় দিনের মাথায় জ্বর পুনরায় হবে এবং আরেকটায় চতুর্থ দিন থেকে জ্বর শুরু হবে। প্রায় ১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক মহিলা হেমোরয়েডের চিকিৎসা করার জন্য চীন দেশে যান। সেখানে তিনি ভেষজ চিকিৎসক চিংঘাওয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। চিংঘাও পরে বলেছেন, সেখানে ৫২ রকম রোগ দেখা দিয়েছিল। সেগুলো বেশিরভাগ ছিল মশাবাহিত। অর্থাৎ এ কথা স্পষ্ট ম্যালেরিয়া এবং মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু পৃথিবীতে নতুন কোন বিষয় নয়। সবশেষে, মশা নিয়ে সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। নমরুদ; যে নিজেকে আল্লাহর সঙ্গে তুলনা করত। এমনকি এই উদ্ধত পাপিষ্ঠ আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আকাশের দিকে তীর ছুড়ে মেরে বলেছিল, এই যে আল্লাহকে মেরে ফেললাম! পরে যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহতায়ালা যখন সৈন্য হিসেবে মশাকে পাঠালেন, তখন মশার আক্রমণে নমরুদ ও তার সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আল্লাহর ইশারায় সামান্য এক পতঙ্গের আক্রমণে তাদের বীরত্ব শেষ হয়ে যায়। মশা স্বৈরাচার, নাস্তিক শাসক নমরুদের নাকের ভেতর ঢুকে তাকেও ধ্বংস করে।
×