ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

‘শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে’

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

‘শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে’

১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল সোমবার। ৫০ জনের একটি গেরিলা দল রাত ৮টার সময় মাদারীপুরের নড়িয়া থানার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজের গেরিলারা থানাটি দখল করে। যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা ও পুলিশ নিহত হয়। থানার দারোগাও এতে নিহত হয়। থানা থেকে ৩০টি রাইফেল এবং একটি বেতার যন্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। গেরিলারা থানাটি ধ্বংস করে দেয়। গেরিলাদের আরেকটি দল ঝিকরগাছির নিকট বরিশাল-ফরিদপুর টেলিফোন লাইনের ৬শ’ গজ কেবল নষ্ট করে দেয়। টেলিগ্রাফ বিভাগের টেকনিশিয়ানরা পাকসেনাদের পাহারায় টেলিফোন লাইনটি মেরামত করতে আসার পথে গেরিলাদের বসানো মাইন বিস্ফোরণে তাদের জিপটি ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনাদের আরেকটি টহলদার দল মাদারীপুরের হাওলাদার জুট মিলের কাছে গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় চারজন পাকসেনা নিহত হয়। গেরিলারা মাদারীপুরের কাছে ঘাট মাঝিতে প্রায় ৩০-৪০ গজ রাস্তা কেটে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মাদারীপুর-ফরিদপুর রাস্তায় সমাদ্দার ফেরিঘাটে একটি ফেরি অগ্নিসংযোগে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একটি মোটর লঞ্চও ধ্বংস করা হয়। এই মোটর লঞ্চটি পাকসেনারা টহল দেয়ার কাজে ব্যবহার করত। ২নং সেক্টরে পাকসেনাদের অপর একটি শক্তিশালী দল লঞ্চে মাদারীপুরের দিকে তৎপরতা আরও জোরদার করার জন্য আগ্রসর হয়। এই খবর মুক্তিফৌজের গেরিলারা আগেই পেয়ে যায়। ২০ জনের একটি গেরিলা দল পালং থানার রাজগঞ্জের কাছে নদীর তীরে পাকসেনাদের জন্য এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। সকাল ১০টার সময় লঞ্চটি মুক্তিফৌজের গেরিলা দলের এ্যামবুশের আওতায় এলে তৎক্ষণাৎ গেরিলারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে ১০-১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। সিলেটে হানাদার বাহিনী ভোগা ও করমপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহের উপর তীব্র হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য ও ৪ জন রাজাকার নিহত হয়। ৭নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর প্রেমতলী অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ২ জন পাকসৈন্য ও ২ জন রাজাকার নিহত হয়। চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ শেষে কয়েকজন পাকসেনা অফিসার হেঁটে যাওয়ার সময় পলোগ্রাউন্ডের প্রবেশ মুখে এম এ জিন্নাহর মুক্তিযোদ্ধা দল তাদের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এতে ৩ জন পাকসেনা অফিসার নিহত হয়। ফেনীতে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর দুই প্লাটুন সৈন্যকে বিলোনিয়া নদী অতিক্রমের সময় আক্রমণ করে। এতে পাকবাহিনীর ১৫ জন সৈন্য নিহত হয়। বাকি সৈন্যরা মর্টারের শেলবর্ষণ করার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়। ৬নং সেক্টরে লে. কর্নেল দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৩০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল মোগলহাট রেললাইনের ওপর এ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন, গ্যালাটিন ও পি.ই.কে বসিয়ে অবস্থান নেয়। পাকসেনা বোঝাই একটি ট্রেন অগ্রসর হলে মাইনের আঘাতে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি বিধ্বস্ত হয়। পাকসেনারা সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে গুলি শুরু করে। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৫ জন সৈন্য নিহত হয়। এই অপারেশনের খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। চাঁদপুরের নিকটবর্তী আকন্দহাট বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানি তাদের বেস স্থাপন করে। স্থানীয় দালাল এবং রাজাকাররা পাকসেনাদের এই বেস সম্বন্ধে খবর দেয়। এই বাজারটির তিন দিকে পানি থাকায় সৈনিকরা বেসটিকে যথেষ্ট নিরাপদ মনে করত। সকাল ৬টার সময় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় এই বেসটি আক্রমণের জন্য আসে। আক্রমণের সময় তারা নৌকার সাহায্যে খাল পাড় হয়ে বেসে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। পাকসেনারা কাছে পৌঁছলে মুক্তিফৌজের সৈনিকেরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। দুই ঘণ্টার যুদ্ধে একজন মেজরসহ ৩৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। খাল পাড় হতে না পেরে এবং অনেক হতাহতের ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মুক্তিফৌজের কোম্পানিটি পরে নিরাপদে সেখান থেকে অন্য বেসে চলে আসে। ভোরে হানাদার বাহিনী ছয় ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লঞ্চার দিয়ে শঠিবাড়ি বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার এবং ডিফেন্সে তুমুল আক্রমণ শুরু করল। একদিকে খাবার নেই। আড়াই দিন পার হয়ে যাচ্ছে। বিস্কুট এবং পানি খেয়ে বেঁচে আছে তিন শ’ মুক্তিযোদ্ধা। শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধে আহতরা পরে আছে বাঙ্কারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে কামানের গোলা মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সবদিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তবু মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেল। সবকিছু অনিশ্চিত জেনেও দাঁতে দাঁত কামড়ে জীবনবাজি রেখে লড়ে গেল শঠিবাড়ি বন্দরে। রাত আটটায় শঠিবাড়ির ডানদিকে মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিকভাবে তিনশ’ গজ ছুটে গিয়ে হানাদারদের কয়েকটি ডিফেন্স পজিশন দখল করে নেয়। এটি ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেই ডিফেন্স লাইনে ছিল প্রায় দেড় শ’ রাজাকার। তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আহত কোম্পানি কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রন্ট লাইনে বসিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি চালাবার আদেশ দেয়া হয়। ধৃত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। চাঙ্গা হয়ে ওঠে তারা। সারারাত গুলি আর পাল্টা গুলি চলতে থাকে। ৭ সেপ্টেম্বর ভোর বেলা পাকবাহিনী অবস্থান ত্যাগ করে নিলফামারির দিকে পালিয়ে যায়। রাজশাহী জেলার রানী শংকইল হরিপুর রোডে পাকসৈন্য বহনকারী এক পাক গাড়ির বিস্ফোরণে ৫ জন সৈন্য নিহত হয়। একই এলাকায় মুক্তিফৌজের ভিন্ন অপারেশনে আরও ৬ জন সৈন্য নিহত হয়। ঢাকায় সামরিক আদালত ৪৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। সিলেটে শান্তি কমিটির আহ্বায়ক শহীদ আলীর সভাপতিত্বে এক সভায় ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার আহম্মদ রানা প্রশংসনীয় কাজের জন্য রাজাকার সদস্য আদম মিয়া, ওসমান গনি ও আবদুর রহমানকে টিক্কা খানের দেয়া পদক ও প্রশংসাপত্র প্রদান করে। সভায় নিহত দালাল তালাতের নামে হরিপুরের নামকরণ করা হয় ‘তালাতনগর’। সাপ্তাহিক বাংলার বাণীর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার পূর্ব ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বলেন ইয়াহিয়া খানকে ‘সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের মুক্তি দিতে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে’। জন্মভূমি পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায়, গত সোমবার মুক্তিবাহিনীদের ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন বিস্ফোরণের ফলে চট্টগ্রাম ও ফেনী স্টেশনের মধ্যে মহারাজ খ- স্টেশনে খান সেনাদের একটি ট্রেন ধ্বংস হয়েছে। এই বিস্ফোরণের ফলে ট্রেনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং যাত্রীসহ ১০০ জন ঘটনা স্থলে নিহত হয়। এছাড়া মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহের গৌরীপুরে রেল অফিস, পোস্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ধ্বংস করে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এই জেলায় বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে প্রায় জায়গাই জঙ্গী সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। জেলায় সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে শত্রু সেনারা ভীত সন্ত্রস্ত। মুক্তিসেনার আক্রমণে দিশেহারা পাক ফৌজ বিমান ব্যবহার করছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×