ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হিজরতের স্মৃতি সমুজ্জ্বল হিজরী সন

প্রকাশিত: ১১:৪২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হিজরতের স্মৃতি সমুজ্জ্বল হিজরী সন

হিজরত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মুবারক জীবনেতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করেন। এই হিজরতের ফলে ইসলামের সুদূরপ্রসারী বিজয়ের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এই হিজরতের মাহাত্ম্য বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক যোসেফ হেল বলেছেন : It is a turning Point in the life and work of the prophet the great turning point in the history of Islam- এটা হচ্ছে মহানবী (সা)-এর জীবন ও কর্মে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা আর ইসলামের ইতিহাসে মহাদিগন্ত উন্মোচনকারী অধ্যায়। আমরা জানি, প্রিয়নবী (সা) ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে প্রথম ওহী লাভ করেন। প্রথম ওহী লাভের তিন বছর পর আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর আপনজনদের দীনের পথে আহ্বানের নির্দেশ দেন। গুটিকয়েক ভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া মক্কার কাফির মুশরিকরা তাঁর হিদায়াত গ্রহণ তো করলই না বরং তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করল। তাঁর এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ওপর নেমে এলো অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন। তিনি ধৈর্য ধারণ করে হিদায়াতের বাণী পৌঁছানোর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতোমধ্যে বেশকিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তি একে একে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। কাফির মুশরিকদের অত্যাচারের মাত্রা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পেতে লাগল। কাফির মুশরিকরা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটল এবং একদিন রাতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ওঁৎ পেতে থাকল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি হযরত আলী (রা)-কে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে অতি সন্তর্পণে তাঁর কদম মুবারকের বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর ভর করে বেরিয়ে গেলেন। বের হওয়ার সময় এক মুষ্টি ধুলাতে সূরা ইয়াসিনের প্রথম কয়েক খানি আয়াতে কারিমা পাঠ করে ফুঁ দিয়ে তা ওঁৎ পেতে থাকা কাফির-মুশরিককের দিকে ছিটিয়ে দিলেন। কাফির মুশরিকদের শরীরে সে ধুলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তন্দ্রাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সন্তর্পণে বের হয়ে এসে হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুকে নিয়ে ছত্তর পর্বত গুহায় এসে কয়েক দিন থাকলেন। তারপর তিনি মক্কা মুকাররমা থেকে প্রায় ২৯৬ মাইল দূরে অবস্থিত ইয়াসরিব নগরীর উদ্দেশে রওনা হলেন। মক্কা থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি আঁসুসিক্ত চোখে বার বার কা’বা শরীফের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, হে কা’বা আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে বের করে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহর জমিনে তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। হে মক্কা, তোমার সন্তানরা আমাকে এখানে থাকতে দিল না। যদি আমার কওম আমাকে তোমার কাছ থেকে চলে যেতে বাধ্য না করত তাহলে আমি আদৌ তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন আর বার বার চোখের পানি মুছছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব (সা)-কে উদ্দেশ করে ইরশাদ করলেন : আপনি বলুন, হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং আমাকে বের করাও কল্যাণের সঙ্গে এবং তোমার কাছ থেকে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৮০)। প্রিয়নবী (সা) ইয়াসরিব নগরীর তিন মাইল দূরে অবস্থিত নগরীর প্রবেশ মুখ কুবা নামক স্থানে প্রায় ১৫ দিন পরে এসে পৌঁছলে ইয়াসরিবের মানুষ তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করে। তখন ইয়াসরিবের অধিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। সমগ্র জনতা তাঁকে গ্রহণ করার জন্য সমবেত হয়েছিল। ছোট বালক-বালিকারাও তাদের মা এবং অন্যরা সমবেত কণ্ঠে সুললিত উচ্চারণে যে কাসিদা পাঠ করেছিলেন তা আজও মিলাদ মাহফিলে পাঠ করা হয়। এখনও মক্কা মুুুকাররমায় কিংবা মদিনা মনওয়ারায় গেলে দোকানে দোকানে ঐতিহ্যবাহী সে কাসিদার ক্যাসেট বাজতে শোনা যায় এবং কিনতে পাওয়া যায়। আমার কাছেও সে ক্যাসেট আছে। কাসিদাটি হচ্ছে : তালা’আল বাদরু ‘আলায় না মিন ছানিয়াতিল বিদা’ ওয়াজাব শুকরু ‘আলায়না মাদা’আ লিল্লাহি দা’ প্রিয়নবী (সা) কুবাতে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং এখানে স্থাপন করেন একটি মসজিদ যা বর্তমানে কুবা মসজিদ নামে খ্যাত। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার তিনি কুবা থেকে ইয়াসরিব নগরীর উদ্দেশে রওনা হন। বিশাল জশনে জুলুস বা আনন্দ মিছিল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলে ওই কাসিদা পাঠ করতে করতে। পথে আল্লাহর নির্দেশে বণী সালিমে জুমার সালাত আদায় করেন। এটাই জুমার প্রথম সালাত। তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াসরিবের জনগণ তাঁদের নগরীর নাম করেন মদিনাতুন নবীÑ নবীর শহর, যা আজকের মদিনা মনওয়ারা মদিনা শরীফ সোনার মদিনা। মদিনা তশরীফ আনায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ওহী লাভ করার পর তাঁর মক্কী জীবনের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ১২ বছর। মক্কী জীবনের এই সময়কালে তাঁকে মুকাবিলা করতে হয়েছে বহু নির্যাতন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ওপরও নেমে এসেছে কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারের জগদ্দল পাথর। এমনকি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবননাশেরও চেষ্টা করা হয়েছে। মদিনায় তাঁর হিজরত করে আসার ফলে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। মদিনায় স্থাপিত হয়েছে মসজিদে নববী। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কায়েম হয়েছে। রমাদানের এক মাস সিয়াম পালনের বিধান নাজিল হয়েছে, যাকাত ও হজের বিধানও নাজিল হয়েছে। মদিনায় হিজরতের ফলে ইসলামের বিধি-বিধানসমূহ সামগ্রিকভাবে পালনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে, প্রণীত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র মদিনার সনদ। মক্কার কাফির মুশরিকরা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাফল্য সহ্য করতে পারেনি। তারা বার বার মদিনা আক্রমণ করেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আক্রমণই প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছেন। এক কথায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা সম্ভব হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসার ফলে। যে কারণে হিজরতের গুরুত্ব অপরিসীম। আরব দেশে মাস গণনার রীতি প্রচলিত থাকলেও সুনির্দিষ্ট সন বা বর্ষ গণনার রীতি ছিল না বললেই চলে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের ৫০ দিন পূর্বে ইয়েমেনের জালিম রাজা আবরাহা মক্কায় কা’বা শরীফ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে একটি হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে এসে ছাউনি স্থাপন করে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ছোট ছোট পাখি বা আবাবীল পাঠিয়ে আবরাহার বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। কুরআন মজিদে সূরা ফীলে সেই ঘটনার কথা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তুমি কি দেখোনি তোমার রব্ হস্তি অধিপতিদের প্রতি কি করেছিলেন? ওদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছিলেন। যারা ওদের ওপর প্রস্তর কঙ্কর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি ওদের ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন। হস্তি বাহিনীর সেই ঘটনার বছর থেকে আরবরা আমুল ফীল বা হস্তিবর্ষ নামে একটি বর্ষ গণনার সূচনা করলেও তা স্থায়িত্ব পায়নি। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রথম ওহী লাভ করেন। তিনি নবুয়ত ও রিসালতপ্রাপ্ত হন। এর স্মরণে মুসলিম মননে নবুওতের প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর, তৃতীয় বছর এমনিভাবে বর্ষ গণনার রীতি কিছুদিন চালু ছিল। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে এলে হিজরতের হিসেবে বর্ষ গণনা চালু হলেও তা বিধিবদ্ধ সন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর খিলাফতকালে। জানা যায়, খিলাফতের কাজকর্ম, দলিল দস্তাবেজ, নথি, চিঠি খতিয়ান, ফরমান, রাজস্ব আদায় ইত্যাদি জরুরী ক্ষেত্রে সন-তারিখের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। খলীফা হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু একটি খাঁটি ইসলামী ক্যালেন্ডার প্রণয়নের নির্দেশ দেন। খলীফাতুল মুসলিমীন আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু হযরত আবু মুসা আল আশআরী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একটি নিজস্ব সন তারিখের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। একটি নতুন সনের উদ্ভাবনের বিষয়ে তিনি বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শ সভা আহ্বান করেন। এই নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশদ আলাপ আলোচনা হয়। হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুর পরামর্শে তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য যে সনটি প্রবর্তন করলেন সেই সনটিই হিজরী সন। এতে প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশে প্রচলিত বারোটি মাসই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করেন। কিন্তু আরবে প্রচলিত মাসগুলোর প্রথম মাস হচ্ছে মহরম যে কারণে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের পহেলা মহরমকেই নববর্ষের প্রথম তারিখ ধরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। ঠিক এ সময়টাতেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরী সনেরও আগমন ঘটে। হিজরী সন বিশ্ব মুসলিম মননে অতি পবিত্র সন হিসেবে গণ্য হয়। তার কারণ এই সনের মহরম মাসের দশ তারিখে পালিত হয় আশুরা, সফর মাসের শেষ বুধবারে পালিত হয় আখেরি চাহার শম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পালিত হয় ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, ১১ রবিউস সানী পালিত হয় ফাতেহায়ে ইয়াযদহম, ২৭ রজব রাতে পালিত হয় শব-ই-মিরাজ, ১৫ শাবান রাতে পালিত হয় শব-ই-বরাত, মাহে রমাদানের এক মাস পালিত হয় সিয়াম, ২৭ রমাদান রাতে পালিত হয় শব-ই-কদর, শাওয়াল মাসের ১ তারিখে পালিত হয় ঈদ-উল-ফিতর, জিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত পালিত হয় হজ, ১০ জিলহজ পালিত হয় ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ। হিজরী সনের প্রতি মাসের সূচনা হয় চন্দ্র উদয়ের মাধ্যমে। এই চাঁদ দেখার মধ্যেও এক আনন্দ বৈভব রয়েছে। বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখা রীতিমতো এক সাংস্কৃতিক উপাদানে পরিণত হয়েছে। হিজরী সনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই সন মুসলিম জাহানের সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফ
×