ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হওয়া জরুরী

প্রকাশিত: ১১:৪১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হওয়া জরুরী

দেশ যখন উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে, তখন প্রাচ্যের ভাল দিকগুলো মুছে এক শ্রেণীর মানুষের কাছে অমানুষিক প্রবণতা বেড়ে উঠেছে। এটি আমাদের চিরন্তন বাঙালী সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের যে সব সংবাদ সত্য প্রমাণিত হচ্ছে- তা আমাদের বিকারগ্রস্ত মন-মানসিকতার প্রকাশ। এক্ষেত্রে দেশের সমাজবিজ্ঞানী এবং সাইকিয়াট্রিস্টদের করণীয় থাকলেও তারা অনেকটা নিশ্চুপ। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ ধরনের অমানবিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এবং আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আইনের পাশাপাশি দরকার ছিল সামাজিক প্রতিরোধ। আর এ সামাজিক প্রতিরোধ তৃণমূল পর্যায় থেকে নগর পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার আবার একক পরিবার ভেঙ্গে সিঙ্গেল থাকার ইচ্ছা অনেক সময়ে এ ধরনের কর্মকা-কে উৎসাহিত করে থাকতে পারে। এ ছাড়া মনস্তাত্ত্বিক জগতে হতাশা, বেদনা এবং ইঁদুরদৌড় প্রতিযোগিতায় ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে উপরে ওঠার প্রয়াস এ ধরনের নৃশংস ও বর্বর সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশের নারীদের দুই-তৃতীয়াংশ ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ৭২.৭% কখনও এটি প্রকাশ করেননি। আসলে একটি সুখী গৃহকোণ সবার কাছে কাম্যÑ নারী-পুরুষ সুন্দরভাবে গৃহস্থালি সজ্জিত করার। সে ঘর যদি হয়ে ওঠে অত্যাচারের ভূমি তবে তা সামাজিকভাবে নারীকে নিজ ঘরে পরবাসী করার মতো। আমাদের আকাশ সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতির বিকাশ কর্পোরেট এবং বেসরকারী জগতের পৃষ্ঠপোষকতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রসারে ভূমিকা রাখছে। দেশের যে উন্নয়ন, তাতে আজ নারীরা অংশ নিচ্ছে। তারা বাইরে বেরিয়ে আসছে। ফলে ঘরের নির্যাতন ধীরে ধীরে কমতে বাধ্য হবে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক সমস্যাও আমাদের মাঝে প্রকট হচ্ছে। কর্মজীবী মা-বাবারা যখন কর্মস্থলে যাচ্ছেন, ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু উভয়েই কিন্তু নির্যাতনের শিকার কোন না কোনভাবে হচ্ছেন। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রেহাই নেই। কেবল নারীরা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বা হয়, বিদ্যালয়গুলোতে সেটি যে ধরনেরই হোক বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন এমনকি বলাৎকারের শিকার ছেলেরাও হচ্ছেন। এটি একটি সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশকে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ করে ফেলে। শিশু বয়সটি একদিকে ভীতির সঞ্চার করে, অন্যদিক মনস্তাত্ত্বিকভাবে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। ভাবতে অবাক লাগে, সুশীল সমাজের একাংশ এসব ব্যাপারে সামাজিক সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করতে চায়। কিন্তু যে কোন নির্যাতনই সচরাচর সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। জন গ্রে তার বইয়ে ‘পুরুষরা মঙ্গল গ্রহের এবং মেয়েরা শুক্র গ্রহের থেকে’- ভিন্ন প্রজাতির হিসেবে উল্লেখ করেছেন তা আসলে সঠিক নয়। নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক উন্নয়ন একটি দেশকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করতে সক্ষম হবে। সরকার বহু কষ্ট করে মেয়েদের স্কুলে পাঠ-পঠনে উদ্যোগী হয়েছেন। তাতে ব্যাপক সাড়াও পড়েছে। তারপরও এ সমাজেরই একটি অংশ যারা বখাটে বলে পরিচিত তারা মেয়েদের সুযোগ পেলেই টিজ করে। এ ধরনের ক্ষেত্রে একটি মেয়ের মন ভেঙ্গে যেতে পারে এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নিতে পারে। অথচ যারা বখাটে হয়েছে, তারা কি কারণে বখাটে হয়েছে সে সম্পর্কে গবেষণা কাজ ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করাও সমাজকর্মী ও উন্নয়ন কর্মীদের কাজ। আসলে আমাদের দেশের সামাজিক সমাধানে কেবল সরকারের মুখাপেক্ষী থাকলে হবে না- বরং বেসরকারী খাতকে এগিয়ে আসতে হবে- মহল্লাভিত্তিক বোঝানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সত্যি বলতে কি, আজকাল পুরুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। যখন পত্রিকায় নৃশংস ও বর্বর ঘটনা পরি তখন মনে হয় আমাদের বিবেক নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ সমাজে ভাল মানুষের অভাব নেই। কিন্তু যারা খারাপ তাদের জন্য ভাল মানুষেরা আজ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। মানিসেন্ট্রিক সোসাইটিতে এমনটি ঘটতে পারে বিধায় ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কোন অবকাশ নেই। সকল শিক্ষাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে যদি অমানুষ তৈরি হয় সমাজের প্রতি ঔদাসীন্য আমাদের কষ্ট দেয়। অবশ্য ভাল কাজ করছে এমনদেরও ওপরে শিক্ষক হয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিতে দেখেছি। সে শিক্ষক, আসলে কলঙ্কস্বরূপ। কথায় বলে, ‘বিদ্বান দুর্জন হলে পরিত্যাজ্য।’ এখন প্রতিটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে তো আর নজরদারি বসানো সম্ভব নয়। ধর্মীয় শিক্ষাই বলুন, একমুখী শিক্ষাই বলুন আবার ইংরেজী মিডিয়ামে শিক্ষা বলুন- যারা মানুষ গড়ার কারিগর হবেন তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সঠিক হতে হবে। হ্যাঁ! এটিও আমি দেখেছি, ভাল শিক্ষক হলে কিংবা মতাদর্শের মিল না থাকলে ফাঁসিয়ে দিতে চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের অপচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলি অথচ সেখানে কিংবা কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মানবীয় গুণাবলীতে ভাস্বর করা হবে তার ওপর যে পবিত্র দায়িত্ব শিক্ষাগুরুদের পালন করা দরকার, যারা করছেন না বরং নানা অপকর্মে লিপ্ত সে জন্য সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষা নীতি-২০১০ বাস্তবায়ন করা যায়নি। গত দশ বছরে সামাজিক সমস্যাগুলোকে বিবেচনায় এনে শিক্ষানীতি পুনরায় সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশ গড়তে সরকার বদ্ধপরিকর। তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যেভাবে ডোনেশন ভর্তির সময়ে নেয়, এতিমখানায় থাকতে হলেও কোন কোন এতিম ছাত্র-ছাত্রীদের টাকা দিতে হয়। অথচ সাধারণ মানুষ দান-খয়রাত কম করে না। আমি জানি না কেন এমন ধরনের অমানবিক কর্মকা- সামাজিকভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে। যারা পড়তে গিয়ে পুরুষ-নারী বলাৎকারের শিকার হচ্ছেন, আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছেন, কিংবা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে তাদের ব্যাপারে পিতা-মাতা, পাড়া-প্রতিবেশিকে আরও বেশি করে সোচ্চার হওয়া বাঞ্ছনীয়। যতক্ষণ না সমাজ ব্যক্তি স্বার্থে লিপ্ত হবে, মিথ্যা গুজবের বেসাতিতে ভরে উঠবে ততক্ষণ সমাজ থেকে এ পাপাচার কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। যে গডফাদাররা এ ধরনের অপকর্ম করাচ্ছেন তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত। সুস্থ স্বাভাবিক খেলার মাঠ, মুক্তচিন্তার অভাব, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা গান, আবৃত্তি, অনিয়ম, মডেলিং চিত্রাঙ্কন যদি প্রতিটি স্তরের স্কুল-কলেজে নিয়োজিত করা যেত, সমাজের দুস্থ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসার সুযোগ বাধ্যতামূলক করা হতোÑ তবে তা দেশ ও দশের মঙ্গল বয়ে আনত। এমনকি অনলাইন ভায়োলেন্স নারীর প্রতি করা হচ্ছে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে মেয়েরা ইদানীং সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ৭৫% অনলাইন যোগাযোগের ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যায় পড়ছে। ফেসবুক, টুইটার, লিকেডিন, ইউটিউবে নারীকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। এটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব রাখছে। এমনকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য বহুমাত্রিক পরিবেশ তৈরি করছে। আসলে পারিবারিক বন্ধন, শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট করা হচ্ছে। ছেলেবেলায় শিক্ষা অন্তরের অন্তস্তল থেকে উদ্বৃত্ত করতে পারি : যখন প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে তখন অসত্যের বদলে মিথ্যার জয় জয়কার হবে; অমানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হবে, আপদ পাবে পদ। আমাদের মধ্যে যে সামাজিক বৈপরীত্য, অসঙ্গতি এবং লোভ বাড়তে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সেটি কিন্তু আমাদের বাঙালী কৃষ্টি সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় যার যেমন খুশি চলোর নীতি গ্রহণ করা হয়। সে জন্যই লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালক সৃষ্টি হচ্ছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মরছে। আবার ক্ষমতার মদমত্তে নিষেধ থাকা সত্ত্বেত্ত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করছে। এ ব্যাপারে সরকার ত্বরিত সাবধানতা অবলম্বন করেছেন। এদিকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার সঙ্গে কেউ কেউ যুক্ত হচ্ছে। এরা সমাজে নানা রকমের অশান্তি সৃষ্টি করছে; পরিবারেও শান্তি-শৃঙ্খলা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ধনবৈষম্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা, সব সময়ে সবল দুর্বলকে চেপে ধরে। এ অবস্থা বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের পথে যাচ্ছে তখন এটি বাড়বে বই কমবে না। সরকার বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য নানামুখী কৌশল গ্রহণ করেছে বিশেষত উদ্যোক্তা তৈরির জন্য। বেকাররা কর্মসংস্থান পেলে অনেক মাত্রায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও তিক্ততার অবসান ঘটবে। কিন্তু সমস্যা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে যায় লঙ্কায় সে রাবণ হয়। উদ্যোক্তাদের জন্য স্টার্পআপ ডেঞ্জার হচ্ছে, তাতে যেন অর্থের নয়-ছয় না হয় সে জন্য পূর্বে সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার এবং বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন করা দরকার। কেননা সরকারপ্রধানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পেটে ভাতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শন। সেটির প্রতিফলন ঘটাতে হলে কোন একটি বিশেষ কোম্পানি নয় বরং বিশেষায়িত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া বাঞ্ছনীয়। আবার বিদেশে পণ্য রফতানি করলে, সে রফতানি লব্ধ আয় যাতে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রকৃত উদ্যোক্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাওয়ার জন্য সঠিক নীতিমালা প্রয়োজন। এমনকি দেশের যে সমস্ত তরুণ-তরুণী ব্যবসা করতে চান, তাদের জন্যও সঠিক নীতিমালা প্রয়োজন এবং বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ বিতরণ ও রিকোভারি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাধু ইচ্ছা বাস্তবায়িত হোক। সমাজের হিংস্রতা, বর্বরতা মুছে যাক। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হোক। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ [email protected]
×