ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বোনের অনুপ্রেরণায় ক্যারিয়ারের প্রথম স্বর্ণজয় লতার

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 বোনের অনুপ্রেরণায় ক্যারিয়ারের প্রথম স্বর্ণজয় লতার

রুমেল খান ॥ পিঠাপিঠি দুই বোন। দু’জনেই ক্রীড়াবিদ। স্নাতক দ্বিতীয়বর্ষে দু’জনেই পড়েন ঢাকার মিরপুরের বঙ্গবন্ধু কলেজে। ছোটবেলা থেকেই দু’জন নিয়মিত ঝগড়া করেন। তারপরও একে অপরের প্রতি ভীষণ টান। একজনের সাফল্যে অন্যজন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। খেলার কারণে ‘স্থগিত’ রাখেন মধুর মারামারি। শনিবার জাতীয় সামার এ্যাথলেটিক্সে মহিলাদের লংজাম্প ইভেন্টে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শারমিন আক্তার লতা স্বর্ণ জেতেন। এটা জাতীয় প্রতিযোগিতায় তার ক্যারিয়ারের প্রথম স্বর্ণজয়। শনিবার লতার স্বর্ণজয়ের দৃশ্যটি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে দেখেছেন তার বোন লিপা। এ নিয়ে লতার ভাষ্য, ‘স্বর্ণজয়ের পর আমি বোনের দিকে তাকিয়ে আবেগে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। পরে বোন মাঠে নেমে এলে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আরও অনেকক্ষণ কাঁদি।’ লতার চেয়ে এক বছরের বড় তার বোন ফারহানা নাজনীন লিপা একসময় স্প্রিন্টার এবং লংজাম্পার ছিলেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীতে তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দেন (তিনি ২০১৬ সালে জাতীয় স্বর্ণপদক জয়ী তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড়, এবারের এসএ গেমসের ক্যাম্পে আছেন)। নিজের বোন প্রসঙ্গে তার মূল্যায়ন, ‘সবসময়ই লতার ক্যারিয়ার পর্যবেক্ষণ করতাম। একসময় মনে হলো জাম্প করার জন্য যেসব গুণ দরকার, সেগুলোর সবই তার আছে। ওর ওপর আমার অগাধ আস্থা ছিল। তাই ওকে লংজাম্পই বেছে নিতে বলি। আমার কথা মেনে ও সামারে লংজাম্পে প্রথমবার অংশ নিয়ে তৃতীয় হয়। তখন ও নিজেই বুঝতে পারে তার করণীয় কি। গত কয়েকমাসে ভাল কোচের অধীনে ট্রেনিং করে ও অবিশ্বাস্য উন্নতি করে। তার ফল এখন তো দেখাই যাচ্ছে।’ লিপা আরও যোগ করেন, ‘আমি চাই আমার বোন এসএ গেমসের ক্যাম্পে যেন ডাক পায়। আগামীতে ও অনেকদূর যাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।’ ক্যারিয়ারের প্রথম জাতীয় স্বর্ণের গুরুত্ব লতার কাছে ব্যাপক, ‘এ নিয়ে আমার একটা জেদ ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে অন্য ইভেন্টে খেলে সাফল্য না আসাতে আমাকে সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী তাদের পছন্দমতো অন্য ইভেন্টে বাধ্যতামূলক খেলতে হতো। সেই প্রেক্ষাপটে আমি নিজেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন একটি ইভেন্ট বেছে নিয়ে তাতে সফল হই। এই ইভেন্টে গত আসরে তৃতীয় হবার পর থেকেই আমার ভেতরে জেদ চাপে, যেভাবেই হোক আমাকে প্রথম হতে হবে।’ আড়াই মাসের অনুশীলনে এই সাফল্য এসেছে ২০ বছর বয়সী এবং ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী লতার জীবনে, ‘আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিলাম স্বর্ণজয়ের ব্যাপারে। মোটেও ঘাবড়াইনি।’ লতার বাবা আবদুল খালেক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। মা লাকী বেগম গৃহিণী। মেয়ের এই সাফল্যে তারা ভীষণ খুশি। লতার ভবিষ্যত লক্ষ্য দুটি। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া এবং লংজাম্পে জাতীয় রেকর্ড (৬.০৬ মিটার) ভাঙ্গা। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি যার রেকর্ডটি ভাঙ্গতে চান, সেই ফৌজিয়া হুদা জুঁই হচ্ছেন লতার বর্তমান কোচ। এবার লতা লাফিয়েছেন ৫.৫৬ মিটার। ‘জুঁই ম্যাডামকে আমি তার রেকর্ড ভাঙ্গার অভিপ্রায়ের কথা জানিয়েছি। তিনি আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন এ জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।’ যশোরের বাঘারপাড়ার মেয়ে লতারা ২ ভাই, ২ বোন। লতা তৃতীয়। তিনি আগে ছিলেন স্প্রিন্টার (১০০ মিটার রিলে)। মাত্র আট মাস আগে স্প্রিন্ট ছেড়ে দিয়ে বেছে নেন লংজাম্প। স্প্রিন্ট ক্যারিয়ারে তেমন কোন সাফল্য নেই লতার। ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে একটি রৌপ্যপদক জিতেছেন। ২০০৯ সালে স্প্রিন্টার হিসেবে যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থায় যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ২০১৪ সালে। নিবাস হালদারের (এ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সদস্য) মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ট্রেনিং করেন খুলনায়। এরপর কোমরে চোট পান, সে জন্য ভুগতে হয় প্রায় দুই বছর। জাতীয় সামার এ্যাথলেটিক্সে ২০১৭ সালে রিলে দৌড়ে দলীয়ভাবে রৌপ্যপদক লাভ করেন সেনাবাহিনীর হয়ে। ওই আসরেই প্রথমবারের মতো লংজাম্পে অংশ নিয়ে রৌপ্য জেতেন। পরের আসরে লংজাম্পে একটু অবনমন, জেতেন তাম্রপদক। এর কারণ ছিল এ্যাঙ্কেলের ইনজুরি। ‘সেরে উঠে বিকেএসপিতে গিয়ে প্রথমে আনোয়ার স্যার, পরে ফৌজিয়া হুদা জুঁই ম্যাডামের অধীনে অনুশীলন করি। তাদের অনুপ্রেরণাতেই আজ আমি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি।’ লতার ভাষ্য। স্কুলে পড়ার সময় ১০০ ও ২০০ মিটার এবং লংজাম্প- এই তিনটি ইভেন্টেই খেলতেন লতা। সবগুলোতেই বেশিরভাগ সময় প্রথম স্থান অধিকার করেন। জুনিয়র জাতীয় এ্যাথলেটিক্সে ১০০ মিটার দৌড়ে একবার রৌপ্যপদকও পেয়েছিলেন ২০১১ সালে। আট মাস আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন লতা। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট ইভেন্ট ছেড়ে লংজাম্প ক্যারিয়ার বেছে নেন। ‘যেহেতু ইনজুরিতে পড়েছিলাম, তাছাড়া সাফল্যও আসছিল না, তাই ভাবলাম লংজাম্পে চেষ্টা করে দেখি। এছাড়া আমার বোন লিপাও আমাকে এ ব্যাপারে উজ্জীবিত করেছিল।’ এখন দেখা বিষয়, বড় বোনের অনুপ্রেরণায় ইভেন্ট বদলে সফল হওয়া লতা আগামীতে কতদূর যান।
×