ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্ত কর্তৃপক্ষের ধারণা

সায়েন্সল্যাব এলাকায় বোমা হামলায় জঙ্গীগোষ্ঠী জড়িত

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  সায়েন্সল্যাব এলাকায়  বোমা হামলায়  জঙ্গীগোষ্ঠী জড়িত

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের গাড়ির প্রায় এক শ’ গজ দূরে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলার ঘটনাটি ঘটিয়েছে জঙ্গীগোষ্ঠী। জেএমবি বা নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠনটিই সায়েন্সল্যাবে এলাকায় বোমা হামলা চালিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। হামলায় ব্যবহৃত বোমাটিতে টাইমার সেট ছিল বলে মনে করছে পুলিশ। এই জঙ্গীগোষ্ঠীর কাছে টাইমার সেট বোমা, রিমোট কন্ট্রোল, ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসসহ (আইইডি) অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রসদ আছে। বোমা হামলাকারী জঙ্গীগোষ্ঠীটি অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের বোমা হামলা বা নাশকতার জন্য মহড়া বা প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তদন্তের সঙ্গে পুলিশের দাবি। এর আগে গুলিস্তান, মালিবাগে পুলিশের ওপর ও পল্টন ও খামারবাড়ির পুলিশ বক্সের কাছে বোমা রেখে গেছে একই জঙ্গীগোষ্ঠী। রাজধানীর সায়েন্সল্যাবের বোমা হামলার ঘটনার সঙ্গে এর আগের বোমা হামলা ও বোমা রেখে যাওয়ার ঘটনার যোগসূত্র একই । এর আগে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও পুলিশ বক্সের কাছে বোমা রেখে যাওয়ার ঘটনার মতো রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকার বোমা হামলায় পুলিশকেই টার্গেট করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। ভবিষ্যতে পুলিশকে টার্গেট করা ছাড়াও মন্ত্রী, এমপি, ভিআইপিও বোমা হামলার টার্গেট হতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। বোমা হামলার পর এক টুইট বার্তায় সাইট ইন্টেলিজেন্স আবারও বরাবরের মতোই যথারীতি দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস), যদিও বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই বলে আবারও দাবি করা হয়েছে। গত ৫ মাসে খোদ রাজধানীতে পুলিশের ওপর বোমা হামলা ও পুলিশ বক্সের কাছে বোম রেখে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৫টি। এর মধ্যে একটি ঘটনারও রহস্য উদঘাটিত হয়নি। গ্রেফতার হয়নি কোন হামলাকারী দৃর্বৃত্তও। এ কারণে বার বারই পুলিশের ওপর বোমা হামলার ঘটনা এবং পুলিশ বক্সের সামনে বোমা রেখে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত ৫ মাসে যে ৫টি ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে আছে গুলিস্তান, মালিবাগ, সায়েন্সল্যাব এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ৩টি বোমা হামলা এবং পল্টন, খামারবাড়ি পুলিশ বক্সের কাছে বোমা রেখে দেয়ার ঘটনা। শনিবার রাতে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ আমিনুল ইসলাম ও একজন মন্ত্রীর নিরাপত্তা দলের অফিসার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শাহাবুদ্দিন আহত হয়েছেন। শনিবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শাহাবুদ্দিন হাঁটুর নিচে এবং আমিনুলের হাতে জখম হয়েছে। আহত দুই পুলিশ আশঙ্কামুক্ত বলে জানা গেছে। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে হামলার পরিকল্পনা করছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে আইএসের বাংলায় লেখা, ‘শীঘ্রই আসছি, ইনশাল্লাহ...’ ইসলামিক স্টেটকে সমর্থনকারী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া পোস্টারটি প্রকাশের পর সতর্ক অবস্থায় থাকাসহ নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। গত ২১ এপ্রিল সকালে শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের অনুষ্ঠানে ৩টি গির্জা ও ৩টি পাঁচ তারকা হোটেলে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় নিহত হয় ২৫৩ জন। বাংলাদেশের জামা’আতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেএমবিকে তাদের দলে সদস্য নিয়োগের জন্য কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তৎপর হতে দেখা যায়। এরপর থেকেই রাজধানীতে একের পর এক পুলিশের ওপর বোমা হামলা এবং পুলিশ বক্সের সামনে বোমা পুঁতে রাখার ঘটনাগুলো ঘটছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় পুলিশের ওপর বোমা হামলার ঘটনার মতোই হামলার দায় আইএস জঙ্গী সংগঠন স্বীকার করলেও তদন্ত এখনও রহস্যের জালে আটকা পড়ে আছে। রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকার মতো গুলিস্তান, মালিবাগ, পল্টন, খামারবাড়ি-এই চারটি বোমা হামলা এবং পুঁতে রাখার ঘটনারই টার্গেট করা হয়েছিল পুলিশকে। পুলিশকে টার্গেট করা ঘটনাগুলো কে বা কারা কি উদ্দেশে ঘটিয়েছে তা উদঘাটন করতে পারেনি তদন্তকারী পুলিশ। গ্রেফতারও করতে পারেনি কাউকেই। এর আগের তদন্তের অবস্থা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যাওয়ার ঘটনার মতো। সায়েন্সল্যাবের ঘটনার তদন্তে কোন অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। রাজধানীর গুলিস্তান ও মালিবাগে পুলিশকে টার্গেট করে পৃথক দুটি ঘটনা কে বা কারা, কি উদ্দেশে ঘটিয়েছে, এখনও সেই রহস্য উন্মোচন করার আগেই আবারও দুই পুলিশ বক্সের সামনে বোমা রাখার পর তা উদ্ধার করার ঘটনায় মনে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশই টার্গেট। সর্বশেষ সায়েন্সল্যাব এলাকায় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুলিশের ওপর বোমা রাখার ঘটনাটিকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই বলে মনে করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। পুলিশকেই টার্গেট করা হয় ॥ ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, পুলিশকে টার্গেট করেই এই হামলা ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা। রবিবার দুপুরে ডিএমপি সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন তিনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আনুমানিক রাত সোয়া ৯টার দিকে সায়েন্সল্যাব মোড়ে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর পরপরই আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছি। প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, হামলায় ব্যবহৃত বস্তুুটি একটি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ছিল। বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশপাশের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ঘটনাটি এখনও তদন্তাধীন। তাই এ বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত মতামত দেয়া যাবে না বলেও জানান তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রায় তিন মাস আগে গুলিস্তান পুলিশ বক্সকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। এরপর মালিবাগে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। পল্টন-খামারবাড়িতেও পুলিশ বক্সের কাছে বিস্ফোরক পেতে রাখা হয়েছিল। এ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, সব হামলায় টার্গেট ছিল পুলিশ। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে অগ্নি সন্ত্রাসীরা দেশজুড়ে তান্ডব চালিয়েছিল। এরপর বিদেশী নাগরিক তাবেলা সিজারকে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গী হামলা হয়। এরপর পুলিশ দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই কারণে পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এসব হামলার ঘটনা ঘটিয়ে দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করা, অথবা পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব নয়। দেশকে অকার্যকর করতে না পারা, পাকিস্তান-আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো অবস্থা করতে না পারার কারণে একটি গোষ্ঠী পুলিশকে টার্গেট করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন ডিএমপি কমিশনার। গুলিস্তান-মালিবাগে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তে কোন অগ্রগতি আছে কিনা, জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রত্যেকটি ঘটনার বিষয়েই আমাদের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা নানাভাবে খতিয়ে দেখছেন। একটির সঙ্গে অন্যটির কী সম্পর্ক রয়েছে, সেটিও দেখছেন তারা। গুলিস্তান ও মালিবাগের ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্তে আমাদের ভাল অগ্রগতি রয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে ও আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, গুলিস্তানের বোমাটিতে টাইমার সেট করা ছিল। মালিবাগে পুলিশের গাড়িতে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল এবং সেটি রিমোট কন্ট্রোলযুক্ত ছিল। সেটির উপযুক্ত প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। পল্টন ও খামারবাড়ি এলাকায় পুলিশ বক্সে যে দুটি বোমা ছিল, সেগুলো পেতে রাখা ছিল। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ঘটনা ঘটার পরপরই আইএসের দায় স্বীকার করা কতটা সত্য, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোন সংগঠনের যোগাযোগ আদৌ আছে কিনা, নাকি অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব প্রচার, সেটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এজন্য আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। এসব ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক চক্রান্ত রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলা দায়ের ॥ রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে বোমা হামলার ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় মামলা করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের আসামি করে মামলাটি দায়ের করে। বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এক টুইট বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছে সাইট ইন্টেলিজেন্স। শনিবার রাতে টুইটে এই দায় স্বীকার করে আইএস। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি গোপন ইউনিট বাংলাদেশের রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের দুজন অফিসারকে লক্ষ্য করে একটি আইইডি বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরণের সময় ওই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তার গাড়ি থেকে ১০০ দূরে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটে। তেজগাঁও থেকে ধানমন্ডির সীমান্ত স্কয়ারে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন মন্ত্রী। সায়েন্সল্যাব মোড়ে মন্ত্রীর গাড়ি যানজটে আটকা পড়লে মন্ত্রীর নিরাপত্তায় দলের এএসআই শাহাবুদ্দিন গাড়ি থেকে নামেন। তিনি ট্রাফির পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। এতে পুলিশের এএসআই শাহাবুদ্দিন ও ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আমিনুল (৪০) আহত হয়েছেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, এর আগে গত ৩০ এপ্রিল গুলিস্তানে ট্রাফিক পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়। গত ২৬ মে মালিবাগে পুলিশের এসবি (বিশেষ শাখা) কার্যালয়ের সামনে একটি পিকআপে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ২৪ জুলাই রাতে ফার্মগেটের খামারবাড়ি ও পল্টন এলাকার পুলিশের দুটি তল্লাশি চৌকির পাশ থেকে বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
×