ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুমোদনের জন্য আগামী মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন ;###; গঠন করা হবে ইউনিভার্সাল পেনশন অথরিটি

সবার জন্য পেনশন ॥ রূপরেখা চূড়ান্ত, খসড়া প্রস্তুত

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সবার জন্য পেনশন ॥ রূপরেখা চূড়ান্ত, খসড়া প্রস্তুত

এম শাহজাহান ॥ ঘোষণার তিন বছরের মাথায় আসছে সর্বজনীন পেনশন। ইতোমধ্যে এর রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে খসড়া নীতিমালা। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কিভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে পেনশন সুবিধা দেয়া যায়-সে উপায় বের করা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে খসড়া নীতিমালাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। সবার জন্য পেনশন সুবিধা পর্যায়ক্রমে চালু করার লক্ষ্যে একটি ইউনিভার্সাল পেনশন অথরিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উন্নত বিশ্বের মতো সরকারী চাকরিজীবীদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া হয় তিন বছর আগে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও সার্বজনীন পেনশনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা পেনশন ব্যবস্থা চালুর এই উদ্যোগকে সময়োপযোগী বলছেন। শুধু তাই নয়, নীতিমালাটি মন্ত্রিসভায় যাওয়ার আগেই বেসরকারী খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ রয়েছে তাদের। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, এ সংক্রান্ত নীতিমালাটি অনুমোদন হলে প্রথমে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এর আওতায় আনা হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে বেসরকারী খাতের চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষকে এই পেনশনের আওতায় আনা হবে। এতে বেসরকারী খাতের চাকরিজীবীদের সার্বজনীন পেনশনের আওতায় আনতে সময় লাগবে অন্তত আরও তিন বছর। দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। ওই বয়সে ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তা বেশিরভাগ প্রবীণের থাকে না। ফলে দেশের জনগণের একটি বৃহৎ অংশ শেষ বয়সে তীব্র অর্থকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেন। এই বাস্তবতায় সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সবার জন্য পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করার চিন্তা করা হয়। এমন ব্যবস্থার ফলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমবে। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। এছাড়া পেনশন ফান্ড বিনিয়োগ হবে বড় বড় লাভজনক প্রকল্পে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পুঁজির যোগান দিতে সক্ষম হবে পেনশন ফান্ড। জানা গেছে, সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতির কাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় বিষয়ের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আইনী বিষয়গুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি এ বিষয়ে অন্যান্য অভিজ্ঞতা একত্রিত করে নীতিমালা তৈরির কাজ করেছে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আজিজুল আলমের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি। ইতোমধ্যে সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতি ২০০৪ সালে সীমিত আকারে চালু করেছিল ভারত সরকার। কলকাতা ও অসম ছাড়া বাকি সব রাজ্যে এ ব্যবস্থা বর্তমানে চালু রয়েছে। নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আজিজুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, সার্বজনীন পেনশন সুবিধার রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করে আনা হয়েছে। তবে এ নিয়ে আরও কয়েকটি বৈঠক করবে এ সংক্রান্ত কমিটি। তিনি বলেন, রূপরেখাটি সচিব পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠনো হবে। তিনি বলেন, সার্বজনীন পেনশন প্রক্রিয়াটি একটি জটিল বিষয়। এটি কিভাবে পরিচালিত হবে, সেজন্য একটি পরিপূর্ণ অথরিটি গঠন ও আলাদা অফিসের প্রয়োজন হবে। পেনশন ফান্ড গঠন, সেই ফান্ড কোথায় বিনিয়োগ হবে এসব বিষয় নিয়ে এখনো কাজ করা হচ্ছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে শীঘ্রই সার্বজনীন পেনশন সুবিধা চালু করবে সরকার। জানা গেছে, দেশের ছয় কোটি কর্মজীবীর প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখই কাজ করেন বেসরকারী খাতে। চাকরি জীবন শেষে তাদের অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়। এসব কর্মজীবীকে শেষ বয়সে সুবিধা দিতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেও দেয়া হয়েছে সবার জন্য পেনশন বা সার্বজনীন পেনশনের প্রতিশ্রুতি। সে আলোকে দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করছে অর্থ বিভাগ। এ প্রসঙ্গে চলতি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সরকারী পেনশনারগণ দেশের পুরো জনগণের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ দেশের সব জনগণের জন্য একটি সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে চালুর লক্ষ্যে একটি ‘ইউনিভার্সাল পেনশন অথরিটি’ শীঘ্রই গঠন করা হবে। জানা গেছে, ইতোপূর্বে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ওপর একটি ধারণাপত্র দিয়েছিল। ওই ধারণাপত্র পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন ও সংযোজন করে নতুন একটি রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় পেনশন তহবিল হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ চাকরিজীবী ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ তহবিলে অর্থ দেবে। এর পরিমাণ হতে পারে চাকরিজীবীর মূল বেতনের শতকরা ১০ ভাগ। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও সমপরিমাণ অর্থ দেবে। সরকারী ও বেসরকারী খাতে একই নিয়মে তহবিল গঠন করা হবে। পেনশনের এ তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি রেগুলেটরি অথরিটি থাকবে। এ অথরিটির মাধ্যমে পেনশন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমের আওতায় সরকারী চাকরিজীবীদের বয়স হবে ৬০ বছর। তবে বেসরকারী খাতের জন্য ৬৫ বছর। নির্ধারিত সময়ে চাকরি শেষে অর্ধেক পেনশনের টাকা এককালীন তোলা যাবে। বাকি টাকা তহবিলে থাকবে। সে অর্থ পরে প্রতি মাসে ধাপে ধাপে উঠানো যাবে। তহবিল পরিচালনার জন্য আলাদা রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা হবে। তারা লাভজনক খাতে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করবেন। বিনিয়োগ সুরক্ষাও দেয়া হবে। এ থেকে যে মুনাফা আসবে, তার অংশ মাসে মাসে পাবেন সুবিধাভোগীরা। পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেয়া হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সুবিধা থাকবে। সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে অর্থবিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জনমিতিক কাঠামোর পরিবর্তন, নির্ভরশীলতার হার, প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, গ্রাম হতে শহরে অভিপ্রয়ান, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন, আনুষ্ঠানিক বনাম অনানুষ্ঠানিকখাত, সরকারী বনাম বেসরকারীখাত, শ্রমশক্তির সম্প্রসারণ, প্রবাসী জনশক্তি, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অসহনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সার্বজনীন পেনশন একটি ভাল উদ্যোগ। এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার হবে। দ্রুত এটি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রবাসীদেরও পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে হবে। অনেক প্রবাসী চাকরি জীবন শেষে খালি হাতে দেশে ফিরে আসেন। আর্থ-সামাজিক সমস্যাসমূহের গভীরতা উপলব্ধি করে পেনশন সংস্কারে অর্থমন্ত্রী এবং সিনিয়র সচিব উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় পেনশনের বিষয়ে ব্যাপক ভিত্তিক সংস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিক ধারণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জনে শিক্ষা সফর, সম্ভাব্য সংস্কারের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা প্রদান করা হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৯২৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বয়োঃবৃদ্ধদের জন্য পেনশন প্রথার প্রবর্তন করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারীগণকে এ পেনশন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৬৬ সালে পারিবারিক পেনশন-প্রথার প্রবর্তন, পেনশন কম্যুটেশন প্রথার প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর ইংরেজ শাসনামলে প্রণীত পেনশন পদ্ধতি গ্রহণপূর্বক এর নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তিত নীতিমালা অনুযায়ী চাকরির সর্বশেষ ৩৬ মাসের গড় বেতনের পরিবর্তে সর্বশেষ ১২ মাসের গড় বেতন নির্ধারণপূর্বক পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৪-এ বাংলাদেশে সরকারী কর্মচারীগণের পাশাপাশি জাতীয় এন্টারপ্রাইজ এবং কর্পোরেশনের কর্মচারীগণকে অন্তর্ভুক্ত করে গণকর্মচারী (অবসর) আইন ১৯৭৪ প্রণয়ন করা হয়। এর মাধ্যমে গণকর্মচারীগণের চাকরিজীবনের সর্বশেষ উত্তোলনকৃত বেতনের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সর্বোচ্চ ৬০ ভাগ পেনশন প্রদান করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সার্বজনীন পেনশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হিসাব মহা-নিয়ন্ত্রকের অধীনে একটি পৃথক পেনশন এ্যাকাউন্টিং অফিস (পিএও) স্থাপন করা হবে। এর ফলে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে তা হচ্ছে- কেন্দ্রীভূত পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, এ লক্ষ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ডাটাবেজ প্রণয়ন, ভৌতিক পেনশনার সমস্যার সমাধান, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পেনশন কেস প্রস্তুত ও নিষ্পত্তি, পেনশন পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও ইএফটির ব্যবহার, পিএও এর অনুকূলে পেনশন বাজেট বরাদ্দ ও জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। পেনশন সংক্রান্ত নানামুখী জটিলতা নিরসনে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। এতে পারিবারিক পেনশন ব্যবস্থাপনায় জটিলতা দূর হবে, বঞ্চিত পেনশনার সমস্যার সমাধান হবে। পেনশন সম্পর্কিত জটিল ও বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অফিস স্থাপন করা হবে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ সরকারী চাকরে পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার পাশাপাশি গড় আয়ু বাড়ার কারণে জনমিতিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। এতে প্রবীণদের সংখ্যা এবং মোট জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে নগরায়নের কারণে একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাস্তবতায় সকল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীসহ প্রবীণদের জন্য একটি সার্বজনীন ও টেকসই পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে সাড়ে ১১ লাখ অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা ভোগ করছেন। এদের পেছনে বছরে খরচ হয় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এতে সরকারের আর্থিক চাপ তৈরি হয়। এ চাপ প্রশমনে পেনশন তহবিল গঠন করা হচ্ছে।
×