ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্য যুদ্ধ ॥ আমেরিকায় বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ১২:১৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাণিজ্য যুদ্ধ ॥ আমেরিকায় বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে

চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ যতই বিস্তৃত হচ্ছে ততই এই দুই পরাশক্তির বাণিজ্য ক্ষেত্রে টানাপোড়েন বাড়ছে। দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের এক নতুন বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য কিভাবে কৌশল নির্ধারণ করতে এবং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিতে হবে সে ব্যাপারে মার্কিন ও পশ্চিমী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। তহবিল ব্যবস্থাপক ও ওয়াল স্ট্রিটের ব্যবসায়ীরা এই উপসংহারে পৌঁছতে শুরু করেছে যে বিনিয়োগে ধস নামতে পারে এবং তা থেকে মন্দার সূত্রপাত ঘটতে পারে। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাজারের অস্থির আচরণ, নিরাপদ বন্ড কেনার এবং শেয়ার বিক্রি করার হিড়িক থেকে এমন আশঙ্কা হওয়ার কারণ ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন ১ আগস্ট ঘোষণা করে যে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ হাজার কোটি ডলারের চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে শুল্ক বসবে। দুই সপ্তাহ পর সংশ্লিষ্ট পণ্যের দুই-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক আরোপ ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিলম্বিত রাখা হয়। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ ও খেলনা। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় মার্কিন দোকানিরা যাতে বড় দিনের বেচাবিক্রি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ও ভাল ব্যবসা করতে পারে তার জন্যই এই পদক্ষেপ। এমন ঘোষণার পর এ্যাপলের শেয়ারের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে যায় এবং এসএন্ডপি ৫০০ শেয়ারের সূচক লাফ মেরে ১ শতাংশ বাড়ে। কিন্তু পরদিনই শেয়ারের বাজারে দরপতন ঘটে এবং আইফোন প্রস্তুতকারকদের শেয়ারের দাম পড়ে যায় কেননা বিনিয়োগকারীদের এই অস্থিরতা পেয়ে বসে যে শীঘ্রই বিশ্বব্যাপী একটা মন্দা দেখা দিতে চলেছে। আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ দ্বিতীয় দশকে প্রবেশ করা অবস্থায় এই সম্প্রসারণের গতি স্তিমিত হতে পারে। কিন্তু তার পরও ২০১৯ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি সম্মানজনক ২ দশমিক ১ শতাংশ হারে বেড়েছে এবং বেকারত্বের হার রয়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চীনা পণ্যের ওপর শুল্কের প্রত্যক্ষ প্রভাব সামান্যই হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটা হলো বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে তার বৃহত্তর প্রভাব পড়ছে কর্পোরেটগুলোর আচরণের ওপর। বেশিরভাগ কোম্পানি ৫ থেকে ১০ বছর সামনে রেখে তাদের ব্যবসার পারিকল্পনা করে থাকে এবং এমন সব এ্যাসেট বা পরিসম্পদে বিনিয়োগ করে সেগুলোর আয়ুষ্কাল ১০ থেকে ২০ বছর। কিন্তু প্রতিবার নতুন শুল্ক ঘোষণার ফলে তাদের পণ্য সামগ্রীর ব্যবসার নিয়মকানুনের স্থিতিশীলতা কমে যায়। তা ছাড়া বাণিজ্যযুদ্ধের পরিধি এখন পণ্যসামগ্রী ছাড়িয়ে প্রযুক্তি ও মুদ্রায় প্রসারিত হয়েছে। সম্ভবত আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, শিপিং কোম্পানি বা বিদেশী যৌথ উদ্যোগ হবে এই যুদ্ধের পরবতীঁ শিকার। অত্যাধুনিক ব্যবসায় কোম্পানিগুলো এই ঝুঁকিগুলো পরিমাপ করে দেখার চেষ্টা করছে। অবশ্য অনিশ্চয়তার এই উঁচু মাত্রাটা পরিমাপযোগ্য। নিক ব্লুম ও স্টিভেন ডেভিস নামে দুই মার্কিন অধ্যাপকের সমীক্ষায় মার্কিন বাণিজ্য নীতির এই অনিশ্চয়তা বেরিয়ে এসেছে। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাণিজ্য নীতির অনিশ্চয়তার সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে যা বাস্তব ক্ষেত্রে সত্যিকারের প্রভাব ফেলে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে তাদের সূচক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে এবং লোক নিয়োগ মন্থর হয়ে পড়েছে। আরও সাম্প্রতিক একটি তথ্য হলো ‘মুডিস এনালাইটিক্স’ নামে একটি অর্থলগ্নি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানের রায়ান সুইট লক্ষ্য করেছেন যে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আস্থার পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক নীতির অনিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করে ম্যানেজারদের মূলধন ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেয়া যায়। এ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমেরিকার বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে এখন কেমন মনে হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে একটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সেটা হলো দ্বিতীয় প্রান্তিকে অনাবাসিক ব্যবসায় বিনিয়োগ বার্ষিক শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধ এ ব্যাপারে কতটুকু দায়ী? এক্ষেত্রে ‘দি ইকোনমিস্ট’ ৪২টি সেক্টরে প্রায় ২৪০০ তালিকাভুক্ত মার্কিন কোম্পানির ওপর একটি বিশ্লেষণ চালিয়েছে। সেই বিশ্লেষণে কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের মাত্রা এবং চীনা উপকরণের ওপর তাদের নির্ভরশীলতার মাত্রাÑ দুটোই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। দেখা গেছে যেসব কোম্পানির চীনের ওপর নির্ভরতার মাত্রা বেশি তারা বিনিয়োগের রাশ টেনে ধরেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ী কর্মকর্তারাও বিনিয়োগের ওপর বিরূপ প্রভাবের কথা জানিয়েছে। গত জানুয়ারিতে আটলান্টার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্কলিত এক জরিপে দেখা যায় চীন-মার্কিন বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে বিনিয়োগ ১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। শুল্কই এর প্রধান কারণ। ওয়াল স্ট্রিটের অর্থনীতিবিদরাও বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা কিভাবে কোম্পানিগুলোর আচরণ বদলে দিচ্ছে সে ব্যাপারেও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। গোল্ডম্যান শ্যাসের গবেষকরাও সম্প্রতি বলেছেন যে যেসব খাতের কোম্পানি চীনের কাছে অধিকতর পণ্য বিক্রি করবে সেগুলোর বিনিয়োগ বৃদ্ধি চীনের কাছে অপেক্ষাকৃত কম পণ্য বিক্রিকারী কোম্পানিগুলোর তুলনায় মন্থর হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক চিত্রটা হলো এই যে বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বেশ কিছু কোম্পানি যে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে সে ব্যাপারে এখন সুদৃঢ় প্রমাণ আছে। নৈরাশ্যবাদীরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে মূলধন ব্যয় এভাবে হ্রাস পাওয়ার নেতিবাচক পরিণতি সুদূরপ্রসারী ও অধিকতর বেদনাদায়ক হতে পারে। শেষ পর্যন্ত এতে উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে এবং স্বল্পমেয়াদী বিচারে শ্রমিক নিয়োগ কমে যেতে পারে। অনেক কিছুই নির্ভর করছে চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করবে কিনা তার ওপর। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×