ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৌসুম শুরু হলো আজ থেকে

ইলিশ নয়, যেন রূপোর থালা কেনার ধুম

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ইলিশ নয়, যেন রূপোর থালা কেনার ধুম

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর পাতে এক টুকরো ইলিশ হলে আর কিছু চাই না। স্বাদে যেমন, তেমনি ঘ্রাণ। ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। খাবার মেন্যুতে ইলিশ থাকলে বাকি সব নস্যি! অবশ্য ইলিশ সবখানে সব সময় পাওয়া যায় না। মাছের রাজা বলে কথা। যেখানে সেখানে যখন তখন পাওয়া গেলে চলে? রাজার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয়। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে সম্প্রতি। গত কয়েকদিন ধরে বাজার ভর্তি ইলিশে। দু’টো ইলিশ খাওয়ার লোক নেই ঘরে। তাতে কী? দু’ হালি কিনে তবেই ঘরে ফিরছেন কর্তা। আর গিন্নিটি? চার হালির জন্য প্রস্তুত করছেন ডিপফ্রিজ! আলমাড়িতে শাড়ি সাজানোর মতোই ইলিশ দিয়ে ফ্রিজ সাজাচ্ছেন বৌয়েরা। মায়েরা। টেলিভিশন দেখে ইলিশের নতুন নতুন রেসিপি খাবার টেবিলে হাজির করছেন তারা। সব মিলিয়ে দারুণ একটা ব্যাপার। উৎসবের আমেজ। গত কোরবানির ঈদের আগে থেকে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাজারে। ক্রমে সরবরাহ বেড়েছে। এবার প্রাক মৌসুমেই ভরে উঠেছিল বাজার। মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, ইলিশের দুটি মৌসুম। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত একটি। অন্যটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। সে হিসেবে আজ ১ সেপ্টেম্বর থেকে মূল মৌসুম শুরু হলো। এবং এ মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। এবারও তা-ই হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন ইলিশ আসছে ঢাকার আরতে। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে সব কাঁচাবাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। এখন কাঁচা বাজারে। ফুটপাথে। অফিসের সামনে। ইলিশ আর ইলিশ শুধু। গত কয়েকদিন ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে মনে হয়েছে, আর কোন মাছ নেই। ছিল না কোনকালে! যাবতীয় হুড়োহুড়ি ইলিশ নিয়ে। আরতদার ও দোকানিরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে বাজারে যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তার অধিকাংশই আসছে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে। বরিশাল, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুরসহ কয়েকটি এলাকা থেকে ঢাকায় ঢুকছে ইলিশ। আসছে চট্টগ্রাম থেকেও। সবই স্বাদের। তবে পদ্মার ইলিশ না খেলে মন ভরে না। পেট ভরে। মনে ক্ষুধা থেকেই যায়। এ কারণে মাওয়া বা চাঁদপুর থেকে আসা ইলিশের বিশেষ কদর। কম আসছে। তাই কিনে ফেলতে হচ্ছে ঝটপট। বড় আকারের ইলিশের বেশি চাহিদা। সাধ্যের কথা ভাবতে হয় যাদের, তারা মাঝারিটা কিনছেন। ছোট মাছ তেমন পাত্তা পাচ্ছে না। তবে যে কোন ইলিশ কেনার সময় দাম দর করা হচ্ছে। ইলিশ হাতে দেখলেই লোকে জিজ্ঞেস করছেন, কত করে কেজি কিনলেন, ভাই? এভাবে একটা পূর্ব ধারণা নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে বাজারে গেলে ধারণা প্রায়শই উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। তবুও ইলিশ কেনা থেমে নেই। থেমে থাকে না। শনিবার সকালে কাওরান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আড়ত থেকে বাইরে চলে এসেছে সব ইলিশ। বিজিএমইএ ভবনের উল্টোদিকে মাছের আড়ত। তার ঠিক পাশের ফুটপাথে যেন হাট বসেছে। মাছের কারবারিরা সব বাদ দিয়ে শুধু ইলিশ নিয়ে আছেন। প্রত্যেকটি ঝুড়ি যেন রূপোর থালা! কিছু মাছ চোখের সামনে সুন্দর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আকারে বড়। চমৎকার গায়ের রং। বাকিগুলো বরফকুচির নিচে। লেজ বা মাথা একটু বের করা। ‘আসলটা দেখবেন? দাম কিন্তু একটু বেশি হইব’ বলেই সেগুলো টেনে বের করছেন দোকানিরা। হাতে নিয়ে দেখাচ্ছেন। সাদেক আলী নামের এক বিক্রেতা তার বড় ইলিশটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘দেখেন, গায়ের রংটা দেখেন খালি। মাথা দেখেন, ছোট। আর ঘাড় উঁচা। এইটাই হইলো আসল চাঁদপুরের ইলিশ।’ চাঁদপুরের ইলিশ আকারে খুব বড় না হলেও, ‘অরজিনাল টেস্ট’ বলে জানান তিনি। এ কারণে তার ইলিশের দাম একটু বেশি। বারো শ’ টাকা কেজি। পাশে বসা আরেক বিক্রেতা বিল্লালের কাছে ফরদিপুরের ইলিশ। তাই বলে দাম কিছু কম বলে মনে হলো না। এগারো শ’ টাকা কেজি চাইছিলেন তিনি। তার যুক্তিÑ ‘মাছের সাইজ তো বড়। বড় ইলিশের দাম বেশি। আর ফরিদপুরের ইলিশ হইলেও স্বাদ আছে এই মাছের। দেহেন না বেইচ্যা শ্যাষ কইরা ফালাইছি।’ আল আমিন নামের আরেক বিক্রেতার কাছে পাওয়া গেল ভোলার ইলিশ। প্রায় প্রতিটি মাছ এক কেজির ওপরে। এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করছিলেন তিনি। বিক্রেতার দাবিÑ ‘আমার মাছ দেখতে সুন্দর। তাজা। দুই হাত দিয়ে ধরতে হয় না।’ এভাবে বিভিন্ন এলাকার মাছ। নানা দামে কেনা বেচা হচ্ছে। ক্রেতারাও বেশ সচেতন। সবার মাঝেই একটু দেখে কেনার প্রবণতা। বিক্রেতার মতো ক্রেতারাও কথায় কথায় মাছ হাতে নিতে দ্বিধা করছিলেন না। মাসুম নামের এক ক্রেতা প্রায় সবকটি দোকান ঘুরে সাত কেজি ২০০ গ্রাম ইলিশ কিনলেন। দাম পড়ল ১৩ হাজার টাকা। এই ক্রেতা বলছিলেন, ইলিশ বাজারে আসার পর থেকেই বাসা থেকে কিনতে বলা হচ্ছিল। আজ ছুটির দিন হওয়ায় এসেছি। পছন্দ করে চাঁদপুরের ইলিশ কিনলাম। একবারে বেশি করে কিনে নিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে খাব। আরেক ক্রেতা তেমন সময় নিলেন না। মোটামুটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিনলেন ১৪ কেজি ইলিশ। দাম ২০ হাজার ৪০০ টাকা। নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না তিনি। বললেন, নিজের জন্য কিনেছি। আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও পাঠাব। এ কারণে একটু বেশি করে কেনা। হুটহাট কিনে ফেললেন। মাছ চেনেন মনে হচ্ছে। এমন মন্তব্যে মজার উত্তর দিলেন তিনি। বললেন, ওরা তো আসল ইলিশ বললো। হতে পারে। নাও হতে পারে। ইলিশ তো, রান্না করলে খারাপ লাগবে না। তাই নিয়ে নিলাম। অবশ্য দিন শেষে বেশিরভাগ ক্রেতা বলেছেন, পর্যাপ্ত সরবরাহ সত্ত্বেও দাম বেশি রাখা হচ্ছে। আবার বিক্রেতাদের দাবি, গত বছর এই সময় ইলিশের সরবরাহ আরও বেশি ছিল। এবার সে তুলনায় কম। দামও তাই কম রাখা যাচ্ছে না। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এক দোকানি তো এ-ও বললেন, ‘আপনেরা লেখেন বইলাই ঝামেলা। মাইনষে আইসা কয়, এক কেজি ওজনের ইলিশ পত্রিকায় পড়ছি, চার শ’ পাঁচ শ’ ট্যাকা। কথা হইলো, কন?’ মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের ছবিটাও প্রায় অভিন্ন। এখানে বড় ও মাঝারি ইলিশটা বেশি দেখা গেল। বড় ইলিশ প্রতি কেজি ১ হাজার টাকা। ৮০০ গ্রামের একেকটি ইলিশের কেজি ৬০০ টাকার মধ্যে। এখান থেকে দুই ব্যাগ ভর্তি করে ইলিশ কিনেছিলেন গৃহিণী রওশন আরা। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাসায় মেহমান আসবে। ইলিশ পোলাও আর দই-ইলিশ রান্না করে খাওয়াবো। সে অনুযায়ী মাছ কিনেছেন বলে জানান তিনি। হাতিরপুল কাঁচাবাজারে ইলিশ কিনতে এসেছিলেন ফারহানা বেবী। সরকারি চাকরি করেন। আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে তিনি বললেন, ইলিশে এখন ২০ থেকে ২২টা পদ করা যায়। নতুন নতুন রেসিপি পাওয়া যাচ্ছে ইউটিউবে। ব্যাগের ইলিশগুলো এসব রেসিপি তৈরিতেই ব্যবহার হবে বলে জানান তিনি। এদিকে, আজ থেকে মূল মৌসুম শুরু হলেও দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ইলিশ ধরা যাবে না। এ কারণে শেষের কয়েকদিন ইলিশের দাম বাড়বে বলেই আশঙ্কা। সুতরাং তার আগেই কেনার কাজটি সেরে রাখুন। এখনই উৎকৃষ্ট সময়।
×