ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছায় না ॥ অনুদানের বহু ছবি নানা অজুহাতে চিত্রনাট্যই থেকে যায়

প্রকাশিত: ১০:১৬, ৩১ আগস্ট ২০১৯

 প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছায় না ॥ অনুদানের বহু ছবি নানা অজুহাতে চিত্রনাট্যই থেকে যায়

মনোয়ার হোসেন ॥ বছর গড়িয়ে দশক পেরিয়ে যুগের অবসান হলেও অসমাপ্তই থাকছে অনুদানের চলচ্চিত্র। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া মামলা বা চিঠিতেও নড়ে না ওসব ছবির কাজ। অনুদানের চলচ্চিত্র মানেই যেন অলস চলচ্চিত্র। এক দশক আগে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান পেয়েছিলেন নির্মাতা জুনায়েদ হালিম। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল’ নামে চলচ্চিত্রের কাজ শেষ হয়নি ’১৯ সালেও। ফলশ্রুতিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে এই নির্মাতার নামে। খ্যাতিমান নির্মাতা সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি ‘একা একা’ নামে চলচ্চিত্রের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদান পেলেও সেই ছবির কাজ এখনও শুরুই হয়নি। অবশ্য অসুস্থতার কারণে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বদলে তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। অনুদানপ্রাপ্তির অর্ধযুগ পেরোলেও নারগিস আক্তার পরিচালিত ‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবির নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। ছবি নির্মাণে বিলম্ব হওয়ায় এসব নির্মাতার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি সেপ্টেম্বরে সেন্সর বোর্ডে জমা দেবেন বলে জানিয়েছেন এই নির্মাতা। একই অর্থবছরে ‘কাঁটা’ নামের চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান নিয়ে কাজ শেষ করেননি টোকন ঠাকুর। সময়মতো ছবির কাজ শেষ না করায় তার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। অনুদানের এমন অসংখ্য ছবি নিয়ে রয়েছে জটিলতা। এর মধ্যে অনেক ছবির ভাগ্য অনিশ্চিত। এসব ছবি কবে মুক্তি পাবে কিংবা আদৌ মুক্তি পাবে কি না তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কখনও পরিচালকের খামখেয়ালি, কখনও অসুস্থতা আবার কখনও বা বাজেট স্বল্পতার অজুহাতে অনুদানের চলচ্চিত্র চিত্রনাট্যই থেকে যায় প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছায় না। আর এভাবে ক্রমাগত লঙ্ঘিত হচ্ছে অনুদানের চলচ্চিত্রের নীতিমালা। চলচ্চিত্রের অনুদান নীতিমালা অনুযায়ী, অনুদানের প্রথম চেকপ্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে ছবির নির্মাণ কাজ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখার কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত এক দশকে অনুদানপ্রাপ্ত ২২ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। অন্যদিকে অনুদান পেয়ে মুক্তি না পাওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৮। সময়মতো ছবির নির্মাণ শেষ না করায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে তিন নির্মাতার বিরুদ্ধে। ছবি নির্মাণের তাগিদ বা অগ্রগতি জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে অনেককে। মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, এসব ছবি নির্মাণাধীন। এই নির্মাণ প্রক্রিয়া কবে শেষ হবেÑসে প্রশ্নের উত্তর নেই। যথাসময়ে অনুদানের ছবি নির্মিত না হওয়ার পেছনে রয়েছে নির্মাতাদের নানা যুক্তি। এমন বাস্তবতায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে এসব ছবির জন্য ইতোমধ্যে বরাদ্দ অর্থ। অনুদানের ছবি সময়মতো নির্মাণ না হওয়ায় নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা হলেও শেষ হয় না নির্মাণ কাজ। এসব মামলায় তেমন কোন জরিমানা কিংবা শাস্তি হয় না কোন নির্মাতার। এ কারণে অনুদান নিয়ে সঠিক সময়ে ছবি শেষ করতে না পারা নির্মাতারাও পাত্তা দেন না মামলাকে। তাই মামলা ‘হজম’ হলেও অনুদানের ছবির নির্মাণ কাজ শেষ হয় না। প্রয়োজনে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে অনুদানের ছবির সময় বাড়ানো যায়। কিন্তু বারবার সময় বাড়িয়ে নিয়েও ছবি শেষ করতে পারেননি অনেক পরিচালক। এমন বাস্তবতায় কিছু নির্মাতার বিরুদ্ধে অনুদানের টাকায় ছবি না বানিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যয় করে অর্থ অপচয় ও নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। সময়মতো ছবি জমা দিতে না পারার কারণ হিসেবে অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন, সব ছবিই ৯ মাসের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয় না। কেউ বলেছেন, ছবির চিত্রনাট্য তৈরির সময় প্রকৃত বাজেট বুঝতে পারেননি। পরবর্তীতে দৃশ্যায়নের সময় সেই ছবির বাজেট বেড়ে যাওয়ায় ঝুলে গেছে ছবির কাজ। অনুদানের চলচ্চিত্রের নীতিমালা লঙ্ঘন সম্পর্কে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তার মাধ্যমে মন্তব্য জানতে চাইলেও পাওয়া যায়নি জবাব। এ বিষয়ে তথ্যসচিব আবদুল মালেক বলেন, এ নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। তবে অনুদানের চলচ্চিত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনটি ছবির নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার মাধ্যমে এ্যাকশন নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্য ও নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, নির্মাতাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় সঠিক সময়ে নির্মিত হচ্ছে না অনুদানের চলচ্চিত্র। ছবির অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর পার হওয়ায় নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। ছবি বানাতে না পারলে তাদের অনুদান দেয়ার দরকারটা কি? অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রত্যেকেরই উচিত সময়মতো ছবিটি নির্মাণ করা। এসব নির্মাতাকে মনে রাখতে হবে, জনগণের টাকায় তাদের ছবিটি নির্মিত হচ্ছে। অনেক নির্মাতার অনুদানপ্রাপ্তির পর বাজেট স্বল্পতার অজুহাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্থের পরিমাণসহ সব বিষয়ে জেনেশুনেই তারা আবেদন করেছেন। সে ক্ষেত্রে নির্মাণের বিষয়ে নির্মাতাদের আরও বাস্তবমুখী হতে হবে। যারা অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর ছবির কাজ শেষ করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এক দশকের বেশি সময় আগে অনুদান নিয়ে আজও ছবি নির্মাণ না করার কারণ সম্পর্কে ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা জুনায়েদ হালিম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথম কারণ হচ্ছে আমার ছবির চিত্রনাট্য অনুযায়ী যতটা অর্থের প্রয়োজন সেটা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশাল ক্যানভাসের ছবিটি শুধু অনুদানের টাকায় নির্মাণ সম্ভব নয়। সে সময় সরাসরি অনুদানের ১৫ লাখ টাকা ও এফডিসির আনুষঙ্গিক সহযোগিতাসহ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু আমার ছবিটি নির্মাণের জন্য প্রযোজন দুই কোটি টাকা। ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ছবি হওয়ায় পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যাবে। টাকার জন্য অনেকের কাছে ঘোরাঘুরি করেও শেষ পর্যন্ত টাকা পাইনি। কয়েকটি গানের দৃশ্যায়নসহ কিছু কাজে অনুদানের ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ হলেও এরপর ছবির কাজ আর এগোয়নি। এজন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। তবে এই মামলা আমি কেয়ার করি না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘আমলা’ নামের এই কেরানিমার্কা ব্যক্তিদের দেয়া মামলায় আমার কিছু যায়-আসে না। তারা আর্টিস্টকে কেরানির মতো করে হ্যান্ডেল করতে চায়। আমার চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট পড়ে তাদের বোঝা উচিত ছিল এই ছবির জন্য অনেক বেশি টাকা প্রয়োজন। এক সময় আমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুদানের অর্থ ফেরত দিতে চাইলেও তারা সেটি গ্রহণ না করে কোর্টের মাধ্যমে ফয়সালা করতে বলে। ফলে সুদসহ সেই টাকার পরিমাণ এখন অনেক বেড়ে গেছে। ছবি নির্মাণে বিলম্ব সম্পর্কে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি বলেন, একদিকে ছবির মান বেশি ভাল করতে গিয়ে এবং অন্যদিকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে এটা হয়েছে। আমার বর্তমান শারীরিক অবস্থায় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়। জানতে পেরেছি, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিবর্তে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ দেয়া হবে। সেই প্রক্রিয়া চলছে। আমিও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রস্তুতি নিয়েছি। চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে গেছে। অনুদানের চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন নির্মাতার বিরুদ্ধে অর্থ অপচয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক। এ কারণে যে নির্মাতাকে অনুদান দেয়া হয় আগে তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখা উচিত। তার সততাও যাচাই করতে হবে। অনুদান দেয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওই ছবির বিষয়ে মনিটরিং থাকা প্রয়োজন। অনুদানপ্রাপ্তির দীর্ঘ ছয় বছর পেরুলেও ছবির কাজ সম্পন্ন না হওয়া প্রসঙ্গে ‘যৈবতী কন্যার মন’ চলচ্চিত্রের পরিচালক নারগিস আক্তার বলেন, ছবির চিত্রনাট্য করার সময় প্রকৃত বাজেটটি বুঝতে পারিনি। দৃশ্যায়নের সময় বুঝতে পেরেছি সেলিম আলম দীনের নাটক অবলম্বনে নির্মিত ছবিটির অনুদান ৩৫ লাখ টাকার চেয়ে অনেক বেশি। এটা বুঝতে না পারা আমার জন্য একটা বড় বোকামি হয়ে গেছে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে কাজটি ঝুলে যায়। তবে দেরিতে হলেও নির্মাণের ক্ষেত্রে গুণগত মান রক্ষায় কোন ছাড় দেইনি। ইতোমধ্যে ছবির কাজ প্রায় শেষের পথে। চলচ্চিত্রটি মুক্তির জন্য আগামী সেপ্টেম্বরে সেন্সর বোর্ডে জমা দেব। ‘প্রিয় জন্মভূমি’ নামের চলচ্চিত্রের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুদান পেয়েছেন সোহানুর রহমান সোহান। এই নির্মাতা জানালেন ছবির কাজ এখনও রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। নির্মাণের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, অল্প কিছু দৃশ্যায়নের কাজ হলেও এরপর আর এগোয়নি। মাঝে আমি স্ট্রোক করার কারণে এমনটা হয়েছে। অনুদানের নীতিমালা ভঙ্গ হওয়ার বিষয়টি এই পরিচালককে মনে করিয়ে দিলে জবাবে তিনি বলেন, ছবির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে না পারার জন্য আমি অবশ্যই দায়গ্রস্ত। অনুদানপ্রাপ্ত সব নির্মাতারই সময়মতো ছবির কাজ শেষ করা উচিত। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত তানভীর মোকাম্মেলের ‘রাবেয়া’ ও আবু সাইয়ীদের ‘রূপান্তর’ মুক্তি পেয়েছে। এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’ ছবিটি মুক্তি পায়নি। জানা গেছে, ছবির নির্মাণ চূড়ান্ত করেছিলেন পরিচালক। সেন্সর বোর্ড থেকে এই ছবির সিংহভাগ গল্প পরিবর্তন করতে বলা হয়েছিল। পরিবর্তনজনিত কারণে এখন ‘নমুনা’ ছবির ভাগ্য সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এই নির্মাতা জনকণ্ঠকে বলেন, এ নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাই না। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও শাহজাহান চৌধুরীর ‘আত্মদান’ মুক্তি পেয়েছে। ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল’ না বানানোয় পরিচালক জুনায়েদ হালিমের বিরুদ্ধে মামলা করে তথ্য মন্ত্রণালয় । নির্মাণ সম্পন্ন হলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ‘সূচনারেখার দিকে’ চলচ্চিত্রটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুক্তি পায়নি। পরিচালক আখতারুজ্জামান ’১১ সালে মারা গেলে চলচ্চিত্রটিরও যেন মৃত্যু ঘটে। এই ছবির অভিনেত্রী স্বাগতা জনকণ্ঠকে জানান, ডাবিংসহ ছবির প্রায় পুরো কাজই শেষও হয়েছিল। প্রজেক্টরের মাধ্যমে পরিচালক আমাকে চলচ্চিত্রটি দেখিয়েছিলেনও। একটি ভাল কাজ হয়েছিল। অথচ তার মৃত্যুর পর পোস্ট প্রোডাকশনের সামান্য কিছু কাজ বাকি থাকায় সেটি আর সেন্সর বোর্ডে জমা পড়েনি। পরবর্তীতে কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজটি শেষ করেনি। একই অর্থবছরে নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’, বেলাল আহমেদের ‘অনিশ্চিত যাত্রা’, কাজী মোরশেদুর রহমানের ‘একই বৃত্তে’, সামিয়া জামানের ‘ছেলেটি’ ও সজল খালেদের ‘কাজলের দিনরাত্রি’ নামের ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছয় ছবির মধ্যে আলোর মুখ দেখেনি ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ ও মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘ধোঁকা’ (হরিজন)। এ বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো হলো মানবিক মানবিকের ‘শোভনের স্বাধীনতা’, মুরাদ পারভেজের ‘বৃহন্নলা’, মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ এবং মিঠুন চক্রবর্তীর ‘মুক্তি’। ২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছয় ছবির মধ্যে মুক্তি পেয়েছে মাত্র তিনটি। এগুলো হলো তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলি’, গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া’ ও দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘হেডমাস্টার’। মুক্তি পায়নি সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকির ‘একা একা’, মারুফ হাসানের ‘নেকড়ে অরণ্য’ ও প্রশান্ত অধিকারীর ‘হডসনের বন্দুক’। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে আলোর মুখ দেখেছে চারটি। মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো শাহ আলম কিরণের ‘একাত্তরের মা জননী’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’, জাহিদুর রহিমের ‘মেঘমল্লার’ এবং আকরাম হোসেনের ‘খাঁচা’। নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর এ বছর অনুদানপ্রাপ্ত ‘কাগজের ফুল’ ছবির ভবিষ্যত অনিশ্চিত। অনুদানের টাকা ফেরত দিতে চাইছেন প্রযোজক ক্যাথরিন মাসুদ। কাঁটা ও যৈবতী কন্যার মন ছবি দুটি যথাসময়ে নির্মাণ না করায় মামলা হয়েছে দুই নির্মাতা টোকন ঠাকুর ও নারগিস আক্তারের বিরুদ্ধে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের অনুদানপ্রাপ্ত সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে মুক্তি পেয়েছে প্রসূন রহমানের ‘সুতপার ঠিকানা’, নাদের চৌধুরীর ‘লাল চর’, রওশন আরা নীপার ‘মহুয়া সুন্দরী’, মুশফিফুর রহমান গুলজারের ‘লাল সবুজের সুর’ ও সাজেদুল আউয়ালের ‘ছিটকিনি’। জাঁনেসার ওসমানের চলচ্চিত্র ‘পঞ্চসঙ্গী’র কোন খবর নেই। একইভাবে আলোর মুখ দেখেনি ড্যানি সিডাকের ‘কাঁসার থালায় রূপালি চাঁদ’। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে মুক্তি পেয়েছে মাত্র দুটি। প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছেছে ফাখরুল আরেফীনের ‘ভুবন মাঝি’ ও শামীম আখতারের ‘রীনা ব্রাউন’। আলোর মুখ না দেখা বাকি ছবিগুলো হলো নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, এন রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতী কথা’, মাহমুদ দিদারের ‘বিউটি সার্কাস’ এবং মাসুদ পথিকের ‘মায়া : দ্য লস্ট মাদার’। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে মুক্তি পেয়েছে মাত্র তিনটি। এগুলো হলো মোরশেদুল ইসলামের ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’, বদরুল আনাম সৌদের ‘গহিন বালুচর’ এবং জয়া আহসানের ‘দেবী’। সাবিত্রী ছবির পরিচালক পান্থ প্রসাদ কাক্সিক্ষত চরিত্রের শিল্পী না পাওয়া, অর্থস্বল্পতাসহ কিছু কারণ উল্লেখ করে শূটিং শুরু করতে না পারার কথা জানিয়েছেন। সারা আফরীন প্রযোজিত কামার আহমাদ সাইমন নির্মিত শঙ্খধ্বনি থেকে নাম পরিবর্তিত শিকলবাহা ছবির কাজ রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। মুক্তি না পাওয়া অন্য দুটি ছবি হলো লোরা চৌধুরী প্রযোজিত স্বপন চৌধুরী নির্মিত ‘বৃদ্ধাশ্রম’ প্রবং কাওসার চৌধুরীর ‘বধ্যভূমিতে একদিন’। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে একটির কাজও শেষ হয়নি। শাহরিয়ার সুমিতের ‘নোনাজলের কাব্য‘ ও তানভীর মোকাম্মেলের ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ছবির শূটিং চলছে। শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব সুন্দর’ ছবির কাজ শুরু হয়নি। সোহানুর রহমান সোহানের ‘প্রিয় জন্মভূমির কাজ’ পড়ে আছে প্রাথমিক পর্যায়ে । জসিম উদ্দিন প্রযোজিত কমল সরকার পরিচালিত ‘দায়মুক্তি’ ছবির কাজ শুরু হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দেয়া হয়। এসব ছবির মধ্যে কোনটিরই নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। সেই সুবাদে মুক্তিও পায়নি। অনুদানপ্রাপ্ত ছবিগুলো হলো গাজী রাকায়েত পরিচালিত ‘গোর’, সাইদুল আনাম টুটুলের ‘কালবেলা’, হাবিবুর রহমানের ‘অলাতচক্র’, মানিক মানবিকের শিশুতোষ ছবি ‘আজব ছেলে’ ও আবিদ হোসেন খানের প্রামাণ্যচিত্র ‘অবলম্বন’। এর মধ্য প্রামাণ্যচিত্রটির অনুদান নির্ধারিত হয় ৪০ লাখ টাকা। প্রতিটি কাহিনীচিত্রের অনুদান নির্ধারিত হয় ৬০ লাখ টাকা করে। গত বছরের ডিসেম্বরে কালবেলা ছবির নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল মারা যান। তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই নির্মাতার মৃত্যুতে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছেন তার স্ত্রী অধ্যাপক মোবাশ্বেরা খানম। সর্বশেষ গত এপ্রিলে ২০১৮-১৯ অথবর্ছরে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মিলিয়ে চৌদ্দটি ছবির জন্য ৫ কোটি টাকার অনুদান দেয়া হয়। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শাখার ৯ ছবির মধ্যে কাহিনীচিত্রের সঙ্গে একটি শিশুতোষ ও দুটি প্রামাণ্যচিত্র রয়েছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সারাহ বেগম কবরীর ‘এই তুমি সেই তুমি’, মীর সাব্বিরের ‘রাত জাগা ফুল’, হোসেন মোবারক রুমীর ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’, হৃদি হকের ‘১৯৭১ সেই সব দিন’, শমী কায়সারের ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা’ ও আকরাম খানের ‘নকশি কাঁথার জমিন’। একই শাখায় শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আবু রায়হান মোঃ জুয়েলের ‘নসু ডাকাত কুপোকাত’ এবং দুটি প্রামাণ্যচিত্র হলো হুমায়রা বিলকিসের ‘বিলকিস এবং বিলকিস’ ও পূরবী মতিনের ‘মেলাঘর’। এর মধ্যে শিশুতোষ চলচ্চিত্রসহ চারটি ছবিকে ৬০ লাখ টাকা, তিনটি ছবিকে ৫০ লাখ টাকা এবং দুটি প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ৩০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রতিটি পাবে ১০ লাখ টাকা করে। চলচ্চিত্রশিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দিতে ১৯৭৬ সালে চালু হয় সরকারী অনুদান প্রথা। অনুদান প্রথার সূচনাকাল থেকেই সঠিক সময়ে চলচ্চিত্র নির্মিত না হওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালে অনুদানের প্রথম অর্থবছরে অনুদান পায় চারটি চলচ্চিত্র। মসিহ্উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী নির্মিত তুমুল সমাদৃত ছবি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ মুক্তি পায় ’৭৯ সালে। বাদল রহমানের আলোচিত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ মুক্তি পায় ’৮০ সালে। অনুদানপ্রাপ্তির এক দশক পর ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায় কবির আনোয়ারের ‘তোলপাড়’। বছর পেরিয়ে দশক এবং দশক অতিক্রম করে কয়েক যুগ অতিবাহিত হলেও বেবী ইসলামের ‘মেহেরজান’ আজও আলোর মুখ দেখেনি।
×