ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিমউদ্দীন স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ৩১ আগস্ট ২০১৯

 ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিমউদ্দীন স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অনেকটা নীরবেই চলে গেল তার মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ভাওইয়া যুবরাজখ্যাত উত্তরবঙ্গের কৃতী সন্তান, দেশের বরেণ্য শিল্পী কছিমউদ্দীন। গত ২২ আগস্ট ছিল তার ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুদিবস জানা গেলেও জন্মতারিখ ১৯৩৪ সালের ১২ মার্চ বলে ধারণা করা হয়। একাত্তরের ভাওয়াইয়া ‘কান্দে রে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে বন্দী করিয়া, পদ্মা নদীর পুঁটিমাছ কানী বগার সর্বনাশ, না হয় বাহির না যায় ভিতর গলায় ঠেকিয়া, বগা কান্দে বগি কান্দে গলা ধরিয়া, কান্দে রে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে বন্দী করিয়া’। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাওয়াইয়া যুবরাজ বীর মুক্তিযোদ্ধা কছিমউদ্দীন তার লেখা ও সুর করা যে গানগুলো গেয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা এবং মুক্তিবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করতেন, সংগ্রামী চেতনা জাগাতেন, গান শুনে মুক্তিবাহিনী আনন্দে শূন্যে ফাঁকা গুলি ছুড়তো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে যে পরিস্থিতিতে পড়েছিল গানটি মূলত সেই পরিস্থিতিরই বর্ণনা। গানটির কথায় যেমন (পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতি) ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ আছে তেমনি ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের মাঝেও সে সময়ের বাস্তব পরিস্থিতির তথ্য আছে। কছিমউদ্দীন ছিলেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত ভাওয়াইয়া গানের একজন অন্যতম প্রধান শিল্পী। শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের পর তাকেই ভাওয়াইয়া গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ‘ভাওয়াইয়া গানের যুবরাজ’ বলে সম্বোধন করা হয়। শিল্পী কছিমউদ্দীন মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ক্যাম্পে ভাওয়াইয়া গান গেয়ে সাধারণ জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ভাওয়াইয়া গানের পাশাপাশি পালাগানও পরিবেশন করতেন। এঁরা উপনিবেশের মানুষ ছিলেন না। উপনিবেশের মানুষ মানে তো সেই ব্যবস্থার দোসর হওয়া। ছিলেন কোচ-রাজবংশী, চাড়াল-চন্ডালদেরই সন্তান। কথিত শিক্ষিত হয়ে প্রাণ-প্রকৃতি ও সমাজবিচ্ছিন্ন হওয়ার দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। ফলে তার বিস্মিত হওয়া, ঠোঁট নড়ানো, হাঁটা, সাইকেল চালানো সব তার জনগোষ্ঠীর মতোই। নিজে হালুয়া ছিলেন, জালুয়া ছিলেন, ছিলেন গাড়িয়াল। তাকে শিখতে হয়নি, পাখির শাবককে কি উড়তে শেখা লাগে? মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ক্যাম্পে ভাওয়াইয়া গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এই শিল্পী। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি পালাগানকে করেছেন জনপ্রিয়। অতি দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করলেও জীবদ্দশায় শিল্পী কছিমউদ্দীন দুই সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। তার গানের মধ্যে রয়েছে, ‘ওকি বাপরে বাপ মুক্তিফৌজ কি যুদ্ধ করে বাপরে’, ‘নয়া ডারাতে মাছ উজাইছে, হেঙ্গা পাতেয়া দে’, ‘বাপের বাড়ি মোর ধরলার ওপারে’, ‘বৈদেশিয়া পিরিত রে, ভাঙিলে পিরিতি আর না লাগিবে জোরা রে’, ‘কইন্যা ভাবনা করিস কি, পাটা বেচেয়া কিনিয়া দেইম তোক ফুল তোলা শাড়ি’ প্রভৃতি। যাকে কয়, মাটির ছাওয়া। সাম্য, মুক্তি, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা, সম্মান, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি কথার কচকচানি না শিখেই যারা এসবের জন্য জান বাজি রাখে, ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী কছিমউদ্দীন তেমনই একজন। যিনি চিলমারী ও ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গোয়ালপাড়ার বাঘ বসতি জঙ্গলে জান হাতে নিয়ে হাতির পাল খুঁজে বেড়ান, লোহার অঙ্কুশের ঘা আর গানের নিবেদনে বশ বানান, সেই মাহুতের বীরত্ব-বিরহ ও দারিদ্র্যকে না জানলে গোয়ালপাড়ার মাহুতের গানের মাহাত্ম্য তিনি বুঝবেন কি করে। অথচ কছিমউদ্দীনরা আজ একাডেমিক ব্যক্তি, যেন জাদুঘরের পোড়ামাটি। ভাওয়াইয়া-যন্ত্র ছাড়া ভাওয়াইয়া গেয়ে অনেক বিখ্যাত শিল্পীই ভাওয়াইয়ার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়েছেন। কেউ উচ্চারণ রীতির বদল ঘটিয়েছেন গ্রামোফোন কোম্পানির চাহিদায়। খোদ আব্বাসউদ্দীনও এই চাহিদা পূরণ করেছেন এই পথে। কিন্তু কছিমউদ্দীন, যাকে নিজ গাঁ ছেড়ে যেতে হয়নি, তিনিই ভাওয়াইয়ার পথে থেকেছেন, থেকেছেন কুড়িগ্রামে। তিনিই কেবল ‘পাঁচ আনা রুজি করেছেন পাঁচ সিকার খাইয়া’। এই হলেন কছিমউদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কছিমউদ্দীন। কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কের ধারে পাঁচপীর বাজার। বাজারের মুখেই ভূপতিভূষণ বর্মার ভাওয়াইয়া একাডেমি। একাডেমির ভেতরে ঘর আর বারান্দায় রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। প্রায় ৭০০ বিলুপ্তপ্রায় লোকজ সামগ্রী আছে এখানে। ভূপতিভূষণ এর নাম রেখেছেন কছিমউদ্দীন লোকশিল্প সংগ্রহশালা। এর মাধ্যমে ভাওয়াইয়া যুবরাজকে সম্মান জানিয়েছেন ভূপতিভূষণ। অনেকেই যখন ভুলে গেছে তখন ভূপতিভূষণের মতো মানুষের এই উদ্যোগের মাধ্যমে কিছুটা হলে টিকে থাকবেন কছিমউদ্দীন সেই বা কম কিসে। ২৮তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষে ভাওয়াইয়া যুবরাজের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
×