ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রস্তাব, থিয়েটার কর্মীরা এখন ‘মঞ্চশিল্পী’

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ৩১ আগস্ট ২০১৯

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রস্তাব, থিয়েটার কর্মীরা এখন ‘মঞ্চশিল্পী’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের থিয়েটারকর্মীদের জাতীয় পরিচয় কি হতে পারে সে বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের এক সভায় আলোচনা হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে আয়োজিত সভায় উপস্থিত ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্যরা দেশের থিয়েটারকর্মীদের ‘মঞ্চশিল্পী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি উত্থাপন করেন। পরে বিষয়টি প্রস্তাবনা আকারে সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহিত হয় এবং থিয়েটারকর্মী বা নাট্যকর্মীর পরিবর্তে এখন থেকে ‘মঞ্চশিল্পী’ হিসেবে পরিচয় পাবেন বলে প্রস্তাব করা হয়। এ বিষয়ে সভাশেষে ফেডারেশনের একাধিক নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগে শুরু হয় তুমুল আলোচনা সমালোচনা। পোস্টগুলোতে দেখা যায় অনেকেই ‘মঞ্চশিল্পী’ বিষয়টিকে অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন। বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়ে আরও ব্যাখ্যা দাবি করেন কেউ। আবার কেউ সরাসরি এর বিরোধিতা করে নাট্যকর্মী পরিচয়ে পরিচিত হওয়াকে সম্মানের বিষয় বলে মনে করেন। অন্যদিকে মঞ্চশিল্পী পরিচয়ে একজন থিয়েটারকর্মী হিসেবে মর্যাদা স্বীকৃতি হিসেবে বিষয়টিতে গৌরবান্বিত বোধ করছেন। ‘মঞ্চশিল্পী’ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া কয়েকজনের মতামত নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনের প্রর্থম পর্ব তুলে ধরা হলো। কামাল বায়েজিদ : ‘মঞ্চশিল্পী এবং অনুভাবনা’ শিরোনামে জনপ্রিয় অভিনেতা, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল, নাট্যজন কামাল বায়েজিদ লিখেছেন ‘যন্ত্রশিল্পী, অভিনয় শিল্পী, বাচিক শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, চারুশিল্পীসহ অনেক শিল্পের (আর্ট) শিল্পী রয়েছে, কেবল নেই ‘মঞ্চশিল্পী’। আমাদের বলা হয় নাট্যকর্মী। পৃথিবীর কোন দেশেই নাট্যকর্মী বলা হয় না (জানামতে)। আমাদের দেশের হাজার হাজার মঞ্চশিল্পী, নাট্যকর্মী হিসেবে পরিচিত হয়ে চলছে। যেমন একজন সঙ্গীতশিল্পী কখনই নিজেকে সঙ্গীতকর্মী বলেন না। কিন্তু এই প্রচলিত ‘নাট্যকর্মী’ পরিচয়ের পরিবর্তন দরকার আপনি কি মনে করছেন’। আবার ‘নাট্যকর্মী বনাম মঞ্চশিল্পী’ শিরোনামে লিখেছেন ‘শিল্পী মাত্রই মঞ্চের কর্মী। কর্ম না করে কেউ শিল্পী হয়েছে কিনা জানা যায় না, সে আবৃত্তি, নৃত্য, সঙ্গীত, যন্ত্র, চিত্রকর্ম, মূকাভিনয়, নাটক বা অন্য যে কোন মাধ্যম। শুধু নাটক ব্যতীত সকল মাধ্যমের কর্মীরাই শিল্পী হিসেবে পরিচিত। এ কথা সকলেই জানি এবং মানি যে সকল শিল্পের সমন্বিত শিল্প এই নাটক, আবার নাটকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যেমন- লাইট, সেট, মিউজিকের সঙ্গে যুক্তরাও নাটকের বিশেষ অংশ। এদের বাদ দিয়ে নাটক স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। নাট্যদলের সদস্যদের সম্মিলিত প্রয়াস যখন মঞ্চে উপস্থাপন হয় বা মঞ্চ উপযোগী হয়ে ওঠে তখনই সৃষ্টি হয় নাট্যশিল্প। তবে কেন এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো কর্মী থেকে শিল্পীতে উন্নীত হতে পারছে না! বোধগম্য নয়। কোথায় দৈন্যতা? সময়ই নির্ধারণ করবে কে শিল্পী? কে কর্মী? পশু-পাখী-মানুষ সকলেই জন্ম থেকে কর্মী। কর্মী বলেই কী সেটা জুড়ে দিতে হবে কর্মী মৌমাছির মতো-নাট্যকর্মী! আশ্চর্য! স্বাতন্ত্র্য চর্চায় অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো মঞ্চশিল্পী পরিচয় বহন করতে আমাদের এত মতদ্বৈধতা! অন্যের বিবেচনায় শিল্পী হয়ে উঠব না বলে কী নিজের ভেতরের শিল্পী সত্তাকে একটা পরিচয় আমরা দিতে পারি না? কর্মী কোন স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে না। নাট্যচর্চার মাধ্যমে আমরা মঞ্চসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাই নাট্যকর্মী নয়; মঞ্চশিল্পী আমার পরিচয়। আর এ পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই নাট্যকর্মে আমার দীক্ষা। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নাট্যালোকের মানুষদের স্বীয় অঙ্গনের পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই মতামত দেয় ও সমর্থন করে। মঞ্চশিল্পী হয়ে উঠতে চাওয়া সকলকে মঞ্চশিল্পী হয়ে উঠা, মঞ্চশিল্পী হিসেবে টিকে থাকার পরিক্রমায় একধাপ এগিয়ে দিল। খন্দকার শাহ আলম : বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আজ একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। থিয়েটার শিল্পীদের এখন থেকে মঞ্চশিল্পী বলে সম্বোধন করব। শিল্পে অন্যান্য শাখায় যেভাবে নৃত্যশিল্পী,সঙ্গীতশিল্পী, চারুশিল্পী বলা হয়, শুধু থিয়েটার করলে কর্মী বলতে শেখানো হয়েছে আমাদের, ভালবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে আমরা সে পথে হেঁটেছি যুগ যুগ ধরে। অনেকে মঞ্চ থেকে টেলিভিশনে গিয়ে তারকা হয়েছেন কিন্তু অভিনয় শিল্পী সংঘের সদস্য হবে শুধু মিডিয়ার শিল্পীরা, শুধু মঞ্চে অভিনয় করলে অভিনয় শিল্পী সংঘের সদস্য হতে পারে না। অন্যদিকে থিয়েটার অঙ্গনে যুগ যুগ কাজ করেও কর্মী থেকে গেলেন হাজার শিল্পী। এদের কেউ কেউ হলেন নাট্যজন, নাট্যনেতা। আর সবাই কর্মী অথচ একজন থিয়েটারের মানুষ সব শিল্পের সমন্বয়ে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করেই থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যান, সমস্ত মঞ্চকে ধারণ করেন, এমন শ্রমসাধ্য কাজের সম্মান প্রদর্শনের জন্য এই আহ্বান। একজন মঞ্চশিল্পীকে নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি, সেট, লাইট, মেকআপ এবং মঞ্চের ব্যবহার সবকিছু সমন্বয় করে থিয়েটার নির্মাণ করতে হয়। আর নাট্যজনদের জন্য এমন ভাবনা নয়, নাট্যকর্মীদের জন্য, যারা যুগ যুগ মঞ্চে নাটক করেও শিল্পী নয়, তাদের পরিচয় নাট্যকর্মী। একসময় আবৃত্তি শিল্পী নিয়ে একশ্রেণীর শিল্পীরা বিতর্ক করতেন আবৃত্তিকেশিল্পের মর্যাদা পাবে কিনা? সেদিন যৌক্তিকভাবে বিতর্কে লিপ্ত হতাম। ‘অবশ্যই আবৃত্তিশিল্পী’ বলতে হবে। নাট্যশিল্পী বললে মিডিয়া না মঞ্চ সমস্যায় পড়তে হয়, অন্যদিকে থিয়েটারে অভিনয়ের বাইরেও আলো, রূপসজ্জা, সেট, নির্দশনাসহ নানা শৈল্পিক বিষয়ের সঙ্গে বহু শিল্পী জড়িত বলে এক শব্দে পরিচয় দেয়ার জন্য মঞ্চশিল্পী। যিনি গান, নৃত্য, অঙ্কন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সে যখন তার শিল্পকর্ম জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন নবীন হলেও নিশ্চয়ই তাকে গানকর্মী , নৃত্যকর্মী বলা হয় না। খুব বেশি হলে নবীন শিল্পী বলা হয়। আর শিল্পীর অর্জন আপেক্ষিক বিষয় কিভাবে নির্ধারিত হবে, কে নির্ধারণ করবে অথবা কোন মাপের অর্জন হলে তিনি শিল্পী বলে বিবেচিত হবেন। এখন যদি প্রধান সমস্যা হয় গতকাল এসেই মঞ্চশিল্পী হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা নাট্যদলগুলো প্রাথমিক সদস্যদের শিক্ষানবিশ বলতে পারি। শিল্পের সব শাখা, সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, চারু, যন্ত্রশিল্পী শুধু আমরাই কর্মী। তাছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন নাট্যশিল্পী হিসেবে কয়েক যুগ আগে থেকেই তালিকাভুক্ত করে আসছে। নাট্যশিল্পীদের কিছু সংগঠনও গড়ে উঠেছে। মঞ্চনাটক এ বিভিন্ন সেক্টরে যুক্ত থেকে কাজ করতে হয়, নানামুখী প্রতিভার সমন্বয়, সে জন্য ‘মঞ্চশিল্পী’ বললে সবাইকে এক পরিচয়ে এক শব্দে ডাকা যায়। নাট্যকর্মী শব্দটি যখন প্রচার করা হয় তখন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ছিল না, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি করা হয়েছে, আজকের প্রেক্ষাপটে নিজেদের সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনায় নিয়ে সারাদেশের প্রতিনিধিগণ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কাজেই অনুরোধ আসুন সকলে মিলে একটি সুন্দর চিন্তাকে সমর্থন করি। নাট্যবন্ধুদের প্রতি আহ্বান আসুন নিজেদের ‘মঞ্চশিল্পী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। নূনা আফরোজ : দেশের কাছে, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, বিশ্বের কাছে আপনার পরিচয় কী? পাসপোর্টে আপনার পরিচয় লিখতে গিয়ে কি লিখবেন মঞ্চকর্মী? অন্য কোন দেশে গিয়ে কি আপনি পরিচয় দেন আমি মঞ্চকর্মী? নাকি থিয়েটারের পরিচয়টাই দেন না? নাকি অন্য পরিচয় দেয়াটা আপনার কাছে তখন অধিক সম্মানের হয়? কিন্তু যারা মঞ্চের পরিচয় দিতেই বেশি ভালবাসে? তারা কী বলবে মঞ্চকর্মী? মঞ্চের লোকদের যখন মঞ্চে ডাকেন বা সম্বোধন করেন বিভিন্ন সময় তখন কী বলেন মঞ্চকর্মী রামেন্দু মজুমদার কিংবা মঞ্চকর্মী শিমুল ইউসুফ বা মঞ্চকর্মী সঙ্গীতা চৌধুরী বা মঞ্চকর্মী তপন হাফিজ বা মঞ্চকর্মী মোহাম্মদ আলী হয়দার বা মঞ্চকর্মী রামিজ রাজু বা আলো কর্মী ঠান্ডু রায়হান বা রূপসজ্জা কর্মী জনি সেন? নাচে কেউ নতুন আসলে তাকে কী বলা হয় নৃত্যকর্মী? গানে কেউ নতুন আসলে তাকে কী বলা হয় কণ্ঠকর্মী? ছবি আঁকায় কেউ নতুন আসলে তাকে কী বলা হয় চারুকর্মী? হ্যাঁ প্রকৃত শিল্পী হওয়ার যোগ্যতা আমাদের কারোর নেই। প্রকৃত শিল্পী হওয়া মুখের কথা নয়। আমার চারপাশে আমি তো শিল্পীই দেখি না, সব পারফর্মার, হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতীত তা যে মাধ্যমেই হোক না কেন। কিন্তু আমরা সবাই শিল্পের কাজটা করতে এসেছি। তাই আমাদের পরিচয়টা শিল্পীই হওয়া উচিত। শিল্পীর স্তরভেদ অবশ্যই আছে। তার মানে এই নয় তো দেশের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সমাজের কাছে, বিশ্বের কাছে আমাদের একটি পরিচয় থাকবে না? আমাদের কর্মী হয়ে থাকতে হবে বা লেবার? অন্য দেশের একটি ভিসা ফরম পূরণ করতে গিয়ে আমি আমার পরিচয়ে লিখতে পারব না আমি থিয়েটার আর্টিস্ট বা মঞ্চশিল্পী বা আমি কোন অফিস-আদালতে গিয়ে গর্ব নিয়ে বলতে পারব না আমি মঞ্চশিল্পী নাকি সুবিধামতো তখন অন্য পরিচয় ব্যবহার করব? কোথায় এত অসুবিধে হচ্ছে মঞ্চশিল্পী পরিচয়টি বহন করতে? আর একটি কথা বলি নিজেকে এত সহজে কর্মী বলে ফেলাটা ঠিক নয় ভাই। যথার্থ কর্মী হওয়া অনেক কঠিন কর্ম। কর্মী হবার যোগ্যতা সবার নেই, থাকে না, হয় না। তাছাড়া কর্ম সবখানেই লাগে, কর্ম ছাড়া কোন সিদ্ধি হয় না সেটা আলাদা করে বলার কী আছে? আপনি একাই কর্মী আর কোথাও কর্মী নেই? শিল্পী হয়ে ওঠার চেষ্টা তবু অনেকে করে নিজের স্বার্থে কিন্তু থিয়েটারের স্বার্থে কর্মী হওয়ার চেষ্টা কম মানুষই করে। (চলবে...)
×