ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছিরামিসি গণহত্যা ॥ ৩১ আগস্ট, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ৩১ আগস্ট ২০১৯

ছিরামিসি গণহত্যা ॥ ৩১ আগস্ট, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট দিনটি ছিল মঙ্গলবার। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল শিবপুর থানা আক্রমণ করে থানা ও রাজস্ব অফিস জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিফৌজের গেরিলারা আড়াইহাজার থানা এলাকায় একজন পাক দালালের দু’লাখ টাকা মূল্যের সুতাবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়। তারা থানা থেকে ৮টি রাইফেল, ৫টি শর্টগান এবং ৪০ রাউন্ড গুলি দখল করে। এই খবর পেয়ে নরসিংদী থেকে পাকসেনাদের একটি কোম্পানি ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিফৌজের গেরিলারা আগে থেকেই এর জন্য প্রস্তুত ছিল। পুটিয়রের কাছে মুক্তিফৌজের অপর গেরিলা দল পাকসেনাদের আক্রমণের জন্য এ্যামবুশ পাতে। পাকসেনারা এ্যামবুশের ফাঁদে পড়লে গেরিলারা গুলি চালায়। চার ঘণ্টা সংঘর্ষেও পর ৩৩টি মৃতদেহ ফেলে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে পাকসেনাদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সেলিমও নিহত হয়। সকাল ৯-১০ টায় পাকহানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জে কিছু রাজাকার, আলবদর নিয়ে জগন্নাথপুর হতে ৮-৯টি নৌকায় ছিরামিসি বাজারে আসে। রাজাকার, আলবদররা গ্রামের সকল মানুষকে শান্তি কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়। শান্তি প্রিয় গ্রামের মানুষ শান্তির আকাক্সক্ষায় ছিরামিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। যারা আসতে দেরি করে তাদের ডেকে আনা হয়। আগত সবাই স্কুলে হল রুমে আলোচনা আরম্ভ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময় বর্বররা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ও যুবকদের আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে পেছন দিক দিয়ে হাতগুলো বেঁধে দেয়। পরে ১৫-১৬ জনের এক একটি দল করে এক সঙ্গে বেঁধে নৌকায় নিয়ে নির্বিবাদে গুলি চালায়। কোন কোন দলকে নিকটবর্তী পুকুরপাড়ে সাড়ি বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পানিতে পড়ে বাঁচার চেষ্টা চালালে পুকুরপাড় থেকে পাক বর্বররা এলোপাতাড়ি গুলি করে। এভাবে পাক জল্লাদরা ছিরামিসি গ্রামের ১২৬ জন নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করে। হত্যাযজ্ঞের পর শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। ছিরামিসি বাজারের ২৫০টি দোকান কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে পাক হানাদাররা। সেখান থেকে হানাদাররা জনশূন্য গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ চালায় ও ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা যুদ্ধে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অর্ধশতাধিক মানুষ শহীদ হন। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের ৫০-৬০ জন সদস্য নিহত হয়। ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তার ভাটেরচরের কাছে সড়ক সেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের ওপর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকসেনা এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলারা সেতুটির ৬০ ফুট লম্বা স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তার পরদিন রাতে ঢাকা-দাউদকান্দি সড়কে বারুনিয়া এবং ভবেরচর সেতু দুটিও বিস্ফোরক লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। বোয়ালখালী থানার বিএলএফ কমান্ডার রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী ও সহকারী কমান্ডার মাহাবুবুল আলম চৌধুরী রামগড় থেকে সকালে ফটিকছড়ি প্রবেশ করেন। দুপুর ১২টায় ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলা বাজার সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় এসে পৌঁছালে সর্বপ্রথম পাকিস্তানী সৈন্যদের সম্মুখে পড়ে। বিএলএফএর সদস্যরা তৎক্ষণিক বিচক্ষণতার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। গেরিলা যুদ্ধের কৌসুলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি। পক্ষান্তরে পাকিস্তানী সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মেজর আবদুল হালিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল ধোপাখালী বিওপি থেকে কয়েক মাইল ভেতরে বাঘছড়া থানা হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে। ফেরার পথে মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির একজন সদস্যের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৪টি বন্দুকসহ চারজন রাজাকারকে বন্দী করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতনের বদলে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যবস্থা করা না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ডাঃ এএম মালিক ও লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজীকে যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তবে, সরকারীভাবে বলা হয়, বেসামরিক গবর্নর নিয়োগ করা হলেও সেনাবাহিনী আগের মতোই কাজ করবে। বাংলাদেশে জাতিসংঘ মিশনের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে ৩৮ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠানো হয়েছে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা অনুসারে, বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় প্রমাণ আছে যে এফএও এর গাড়ি ও বোটগুলো বাংলাদেশীদের গ্রেফতার ও অত্যাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল, এই সম্পত্তি দখলের কথা অস্বীকার করতে পারেননি। এমনকি এ ধরনের ঘটনা যে আর ঘটবে না সে আশ্বাসও দিতে পারেননি। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত মিস এলিস থর্নারের প্রকাশিত একটি চিঠির বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। লন্ডনের দ্য সানডে টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক ক্লেয়ার হলিংওর্থ ঢাকা থেকে জানিয়েছেন, খাদ্যসামগ্রীর স্বল্পতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশে শীতকালীন দুর্ভিক্ষ অনিবার্য। বাঘাই তাওয়ালি নামে জাতিসংঘের একজন কর্মী সেখানে ছিলেন। তিনি এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ৭৩ জন কর্মকর্তা নিয়ে এমনভাবে কাজ করবেন যাতে খাবার সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ৬৫ থেকে ৭০ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। চীন থেকেও কিছু খাদ্য পূর্ব পাকিস্তানে আসার কথা আছে। এসব চালান অভ্যন্তরীণ বন্দরগুলোতে পাঠানোর জন্য নৌকা ক্রয় করা হয়েছে কিন্তু নৌ চলাচল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। মুক্তিফৌজের গেরিলাদের রাস্তায় সেট করা মাইনের জন্য সড়কপথে এবং ছোট নৌকা চলাচলে যথেষ্ট হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাতে তো চলাফেরা করা একদমই সম্ভব নয় এমনকি দিনের বেলায়ও বিপজ্জনক হতে পারে। সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়েছে। মান্থলি কনটেম্পোরারি বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর ব্রিটিশ এমপি মি. মি. পিটার শোর বক্তব্য উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করে যে, বাংলাদেশের ঘটনা একটি প্রাচীন জাতির নির্মম মৃত্যু এবং একটি নতুন জাতির জন্মের নাভিশ্বাস। বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা। বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পারি, মোটকথা স্বাধীনতাই পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিকতা আনতে পারে দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণ পরিষদের প্রাক্তন প্রধান এবং বিতর্কিত ‘দ্য ইউনাইটেড স্টোরি’-এর রচয়িতা জেনারেল কাউল বাংলাদেশ বিষয়ে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নেয়ায় তার সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার নতুন বই, ‘কনফ্রন্টেশন উইথ পাকিস্তান’ এ জেনারেল কাউল বলেন, আমরা একটি বিশাল সুযোগ হারিয়েছি, এমন সুযোগ ভবিষ্যতে আর নাও আসতে পারে। আমরা বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর একটা বিরাট অংশকে ধ্বংস করে তাদের দুর্বল করে ফেলতে পারতাম, যা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। কিন্তু আমরা সে সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। জেনারেল কাউল মনে করেন, পাকিস্তান এবং চায়নার যৌথ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ অবশ্যই হুমকিস্বরূপ এবং ভারতের উচিত এখনই এ বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপানের সঙ্গে আলোচনায় বসা। জেনারেল কাউল আরও বলেন, যদি ২৫ মার্চের পর পরই আমাদের আর্মি মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে যেত তা হলে আমরা প্রচুর সুবিধা পেতাম। আমরা পাকিস্তানী ট্রুপের দুটি ডিভিশনকে হাতের নাগালে পেয়ে যেতাম, যারা ওই সময়ে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেটাই হত সবচেয়ে সঠিক ক্যাম্পেনিং সিজন। সমুদ্রে আমরা পাকিস্তানিদের জাহাজের খালাস না করেই জাহাজ থেকে নামতে বাধ্য করতে পারতাম। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা কর্ণফুলী নদীতে মালবাহী একটি বড় বজরা ডুবিয়ে দেয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৩ নং জেটির ঠিক উলটো দিকে বজরাটি ডুবানো হয়েছে। গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অভিযানের সময় বজরাটি ডুবে যায়। ওই সময়ে বন্দরে অবস্থিত কয়েকটি জাহাজ ও ডুবিয়ে দেয়া হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×