ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় পরিচয়পত্র ধরে পুনর্বাসন হলে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই বঞ্চিত হবেন

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ৩১ আগস্ট ২০১৯

 জাতীয় পরিচয়পত্র ধরে পুনর্বাসন হলে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই বঞ্চিত হবেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর মিরপুর-৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তিতে অর্ধ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। গত ১৬ আগস্টের ভয়াবহ অগ্নিকা-ে এখানকার অন্তত ১১ হাজার বাসিন্দা সর্বস্ব হারিয়েছেন। সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাউনিয়া বাঁধে আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কাজ চলছে। এক্ষেত্রে যারা জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানা ‘বস্তি’ লিখেছেন শুধু তারাই এর আওতায় আসবেন। জানা গেছে, এ বস্তিবাসীর মধ্যে খুব কম সংখ্যকই পরিচয়পত্রে একথা লিখেছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন সর্বস্ব হারানো বস্তির বেশির ভাগ বাসিন্দা। এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অধিকাংশই বঞ্চিত হবেন বলে মনে করেন সেখানকার বাসিন্দারা। এ অবস্থায় বস্তিবাসীরা বলছেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রে বস্তির ঠিকানা না থাকলে পুনর্বাসনের আওতায় নেয়া হবে না। তাহলে আমরা কোথায় যাব?’ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই বস্তির বাসিন্দাদের মধ্যে বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নিম্নবিত্ত মানুষ। তাদের বেশির ভাগই জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী উভয় ক্ষেত্রে গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। বাসাবাড়ির মতো বস্তির কোন হোল্ডিং নম্বর না থাকা এবং বস্তিতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ না থাকার কারণেই তারা নাম অন্তর্ভুক্ত করার সময় গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার অফিস, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও স্থানীয় নির্বাচন অফিসের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬০ হাজার বস্তিবাসীর মধ্যে ৫ হাজারের মতো ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানা ঝিলপাড় বস্তি উল্লেখ আছে। তাদের মধ্যে আবার অনেকেই এ বস্তি ছেড়ে ঢাকার অন্য কোনও জায়গা বা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বসবাস করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোট বস্তিবাসীর এক-চতুর্থাংশেরও কম জাতীয় পরিচয়পত্রে বস্তির ঠিকানা দিয়েছেন। তাই কেবল জাতীয় পরিচয়পত্র ধরে পুনর্বাসন হলে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই বঞ্চিত হবেন। এই আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। ইতোমধ্যে তাদের পুনর্বাসনের জন্য বাউনিয়া বাঁধে কাজ শুরু হয়েছে। এখানকার ১০ হাজার পরিবারকে পর্যায়ক্রমে সেখানে স্থানান্তর করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পল্লবী থানা অফিস কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর সেকশন-৭ (পশ্চিম)-এর মোট ভোটার ৯ হাজার ৪৬০ জন। তার মধ্যে ৪ হাজার ৬১৪ জন পুরুষ এবং ৪ হাজার ৮৪৬ জন নারী ভোটার রয়েছেন। এই তালিকায় মিরপুর ঝিলপাড় বস্তি ও স্থানীয় ভোটাররাও রয়েছেন। অন্যদিকে মিরপুর-৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয় থেকে দেয়া তথ্যানুযায়ী, এই বস্তিতে আনুমানিক ৫ হাজার ভোটার রয়েছে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানায় ‘বস্তি’ শব্দ রয়েছে। অপরদিকে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্তির ৬ ও ৭ সেকশনে মোট ৩ হাজার ৩৭৬ জন ভোটার রয়েছেন। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানায় ‘বস্তি’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে সেকশন-৬-এ এক হাজার ৭৭৬ জন এবং সেকশন ৭-এ এক হাজার ৬০০ জন ভোটার। মিরপুর-৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তির নাজু মিয়ার বাড়িতে ১০ বছর যাবৎ ভাড়া থাকেন বাবু শেখ। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তিনি বলেন, ‘আমি ভোটার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায়। গ্রামে ভিটা-বাড়ি না থাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ আমি এই বস্তিতে বসবাস করছি। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রের ঠিকানায় ‘বস্তি’ লেখা না থাকলে আমাদের কেন পুনর্বাসনের আওতায় নেয়া হবে না? আমরা তো সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’ ডিএনসিসির মিরপুর-৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার হাজী রজ্জব হোসেন বলেন, ‘মিরপুর-৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তি অনেক বড়। এই বস্তিতে অনেক লোকের বসবাস। মিরপুর সেকশন ৬ ও ৭ নম্বরের ঝিলপাড় বস্তির অংশে অন্তত ২ হাজার ২শ’ পরিবারের বসবাস ছিল। একটি পরিবারে গড়ে ৫ জন সদস্য ধরে হিসাব করলে বাসিন্দা মোট ১১ হাজারে দাঁড়ায়। এ আগুনে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ এ বস্তির ভোটার সংখ্যা কত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বস্তিতে সব বাসিন্দা তো ভোটার নয়। এখানে বিভিন্ন জেলার গ্রাম থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ এসে বসতি গড়ে তুলেছে। ঝিলপাড় এ বস্তিতে অন্তত ৫ হাজার স্থানীয় ভোটার রয়েছেন। আগুনের ঘটনায় বস্তির অন্তত ২ হাজার স্থানীয় ভোটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের পুনর্বাসনের কাজ চলছে। এখন যাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানায় ‘বস্তি’ শব্দটি রয়েছে শুধু তাদেরই বাউনিয়া বাঁধে পুনর্বাসনের সুযোগ দেয়া হবে।’ মিরপুর-৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তির সেকশন-৬-এর ই ব্লক অংশে আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তির একটি বাড়ি ছিল। ৯টি ঘরের মধ্যে ৬টি ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আগুনে সবই পুড়ে ছাই। তিনি একজন স্থানীয় ভোটার। ২০১৯ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মিরপুর-৬ নম্বর ওয়ার্ডে বস্তির ভোটার সিøপ বিতরণে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মিরপুর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ব্লক ই অংশের বস্তিতে মোট ভোটার ছিল এক হাজার ৭৭৬ জন। আমি এসব ভোটারের সিøপ বের করে বিতরণ করেছিলাম।’ এদিকে মিরপুর-৬ নম্বর ওয়ার্ডের সেকশন-৭ (পশ্চিম) আরামবাগ অংশের বস্তির বাসিন্দা মোঃ সুমন বলেন, ‘সেকশন-৭-এর (পশ্চিম) আরামবাগে বস্তির ভোটার রয়েছে এক হাজার ৬০০ জন। গত সিটি নির্বাচনের ভোটারের হিসাব অনুযায়ী ভোটার তালিকায় বস্তির ভোটার এই ছিল। বাকিরা বস্তিতে বসবাস করলেও তারা এখানকার ভোটার না।’ আগুনে অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র পুড়ে গেছে। তারা সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার কারও কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি বা ভোটার নম্বর নেই। তাই তারা জাতীয় পরিচয়পত্র তোলা ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েছেন। বস্তির বাসিন্দা মোঃ স্বপন। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল সদরে। গত ১১ বছর যাবৎ তিনি এখানে বসবাস করছেন। তবে তিনি এখানকার স্থানীয় ভোটার নন। আগুনের ঘটনায় তার ও পরিবারের সবার জাতীয় পরিচয়পত্র পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে পরিচয়পত্রে কোন ফটোকপি নেই, ভোটার নম্বরও মনে নেই। এখন নিজেই পরিচয় সঙ্কটে পড়ে গেছি। থানায় জিডি করতে গেলেও ভোটার নম্বর দরকার। এখন আমি কী করব?’ থানা নির্বাচন অফিসের (পল্লবী) কর্মকর্তা দেয়ালী পাল বলেন, ‘যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পুড়ে গেছে, তাদের অনেকেই আসছেন। আমাদের কাছে আবেদন দিলে আমরা বই দেখে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করছি। আর যাদের কাছে আইডি কার্ডের কিছুই নেই (ফটোকপি বা ভোটার আইডি নম্বর) তাদের সরাসরি আগারগাঁও নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখানে একটি ডিভাইস (আঙুলের ছাপ নেয়ার যন্ত্র) রয়েছে। ওই ব্যক্তির আঙুল ও হাতের ছাপ দিলে অটোমেটিক তার ভোটার নম্বর উঠে যায়। এরপর ওই নম্বর দেখে আমার তার পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করছি।’
×