ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হিমেল আহমেদ

বিজ্ঞান ও সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ৩০ আগস্ট ২০১৯

বিজ্ঞান ও সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র

মেরি শেলি। বিখ্যাত এই নারী ঔপন্যাসিকের সঙ্গে আমরা যতটা পরিচিত তার চেয়ে অধিক পরিচিত তার লেখা জগৎজয়ী বিজ্ঞান ও কল্পকাহিনীনির্ভর উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে। যেখানে তিনি তার কল্পনায় বিজ্ঞানকে মিশিয়েছেন সাহিত্যের সঙ্গে। কথায় আছে নামে নয় কাজে পরিচয়। ঠিক তেমনি মেরি শেলি যে তার লেখনীর মাধ্যমে আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। ইংরেজী এই মহান লেখিকা জন্মগ্রহণ করেন ৩০ আগস্ট ১৭৯৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে। যা আজ থেকে ২২২ বছর পূর্বে! আশ্চর্য হলো এই ২২২ বছর পেরিয়ে গেল অথচ মানুষ আজও মেরি শেলিকে নিয়ে লিখছে। এটাই তো একজন ভাল লেখকের গুণাগুণ। মৃত্যুর পরও যে লেখক স্বমহিমায় সৃষ্ট কর্মে অমর হয়ে থাকেন। মেরি শেলি তাদের দলের একজন। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে মেরি শেলির লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। যে উপন্যাসকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে কল্পকাহিনীর প্রথম উপন্যাস বলা হয়। মেরি শেলির এই উপন্যাসে আমরা দেখেছি একজন বিজ্ঞানী যিনি একই সঙ্গে ডাক্তার যার নাম ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। যিনি বিভিন্ন গবেষণা করে একটি অতিমানবীয় দানব সৃষ্টি করেন। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রাণের উৎস নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করবেন, যার বদৌলতে পুরো পৃথিবী তাকে আজীবন স্মরণ করবে। তিনি দিন-রাত মানবদেহ এবং এর বিভিন্ন টিস্যু নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। কীভাবে টিস্যু ধ্বংস হয় এবং পুনরায় জন্মানো সম্ভব এসব তথ্য-গবেষণায় তিনি অজান্তেই এক মানব দানবের সৃষ্টি করেন। যাকে দেখে তিনি নিজেও ভয় পেয়ে যান এবং পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু দানবটি তখন শহরে একা ঘুরতে থাকে। এভাবেই এগিয়ে যায় গল্পটি। মেরি শেলির এই উপন্যাস আজও সমাজে সমাদৃত। আজও তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন নাটক, সিনেমা কিংবা গল্প! মেরি শেলিই প্রথম লেখিকা যিনি বিজ্ঞান ও তার কল্পকাহিনীর সুন্দর উপস্থাপক। কিন্তু আমাদের অজানা এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পটি মেরি শেলি অনেকটা কাকতালীয়ভাবে লিখেছিলেন। আর তিনি যে এটা লিখেছেন এটাও প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন না! মেরি শেলির বাবা উইলিয়াম গডউইন ছিলেন একজন মুক্তমনা দার্শনিক, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক লেখক। ‘এনকুইরি কনসার্নিং পলিটিক্যাল জাস্টিস’ হচ্ছে তাঁর লেখা বহুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক বই। তাঁর মা মেরি উলস্টনক্রাফট গডউইন ছিলেন একজন নারীবাদী অ্যাডভোকেট, যিনি ‘দি ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উইমেন’ বইটি লেখার জন্য বিখ্যাত। বাবা মা ও বাসার লাইব্রেরী থেকে প্রচুর সাহিত্য জ্ঞান লাভ করেছিলেন তিনি। এবং তাঁর স্বামী পার্সি বিশি শেলি ইংরেজী সাহিত্যের একজন বিখ্যাত রোমান্টিক কবি ছিলেন। তখন লন্ডনে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন মেরি শেলির বাবা উইলিয়াম গডউইন, তার বাসায় প্রায় আড্ডা দেওয়ার জন্য আসত বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীগণ। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন পার্সি বিশি শেলি। মেরি শেলির বাবা উইলিয়াম গডউইনের ভক্ত ছিলেন কবি পার্সি শেলি। সেই সূত্রে মেরির পরিবারে পার্সি শেলির যাওয়া-আসা শুরু হয়। সবাই যখন গল্পে মেতে উঠত তখন মেরি শেলিও যোগ দিতেন তাদের আড্ডায়। ছোট বেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আলাদা টান ছিল তার। প্রচুর বই পড়তেন তিনি। এসব গল্প ও আড্ডার মাঝে আড়ালেই চলছিল তখন মেরি শেলি ও কবি পার্সি শেলির প্রেম। পার্সি বিশি শেলির কবিতায় মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে যান মেরি। মেরির বয়স তখন ষোল কিংবা সতের! পার্সি শেলিও মেরির প্রেমে বিমোহিত হয়ে তার প্রথম স্ত্রীকে ফেলে মেরীর হাত ধরে পালিয়ে যান ইউরোপে। পার্সি শেলির ইতিমধ্যে বিবাহিত ছিলেন তাই মেরির বাবা এই সম্পর্ক মেনে নেন নি! তাই তারা ভ্রমণ করেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। চলে যান ফ্রান্সে। ফ্রান্সে তখন যুদ্ধাবস্থা! চারদিক হাহাকার আর আর্তনাদ! ফ্রান্সে অনেকটাই দারিদ্র্যতার মধ্যেই জীবন কাটছিল তাদের। পরিবর্তীতে আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ফ্রান্সেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন তারা। মেরি যখন তার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পটি লিখেছিলেন তখন সময় ছিল খৃষ্টাব্দ ১৮১৬। বন্ধু লর্ড বায়রনের আমন্ত্রণে শেলি দম্পতি তখন ছুটি কাটানোর জন্য জেনাভায় অবস্থান করছিলেন। জেনেভার আকাশে তখন খারাপ আবহাওয়া। খারাপ আবহাওয়ার জন্য সবাইকে ঘরেই থাকতে হতো। সময় কাটানোর জন্য তারা বিভিন্ন বিষয়ে গল্প ও আলোচনা করতেন। কেউ ভূতের গল্প বলতেন কেউ বিজ্ঞানের রহস্যের! সঙ্গে ছিলেন লর্ড বায়রন ও জন পলিডরি। তারা দুইজনই ছিল পার্সি শেলির বন্ধুজন। একসময় এই আলোচনায় উঠে আসে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুইজি গালভানির কথা। ১৭৭০ সালে গালভানি বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে একটি মৃত ব্যাঙের পেশিতে স্পন্দন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা করেন এবং তিনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই বিতর্কিত পরীক্ষায় সফল হন। একদিন এরূপ এই আড্ডায় গল্প লেখার প্রতিযোগিতা করা হলো। মেরি শেলি, কবি পার্সি শেলি, লর্ড বায়রন এবং জন পলিডরি মিলে রোমাঞ্চকর একটি গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় বসলেন। লর্ড বায়রন ও জন পলিডরি ভাম্পায়ারকে নিয়ে গল্প লিখলেন। কিন্তু মেরি লিখে ফেললেন এক মানবীয় দানবকে নিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন! সবাই যতটা অবাক হলো ততটা প্রশংসাও করল। এটা একটি ছোট গল্প ছিল পরে পার্সি শেলি ও তার বন্ধুদের অনুরোধে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পটি উপন্যাসে রূপ দেন মেরি। নাম দেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনঃ দ্য মডার্ন প্রমিথিউস। ১৮১৮ সালের পহেলা জানুয়ারি উপন্যাসটি বাজারে আসে। কিন্তু উপন্যাসের মলাটে শুধু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন লেখা ছিল। লেখকের নাম দেওয়া ছিল না। মেরি শেলি কখনো এই রহস্যের খোলাসা করেননি। লেখকের নাম না থাকলেও উপন্যাসটি পাঠক সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। পুরো লন্ডন জুড়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিয়ে আলোচনা সমালোচনা! তখন প্রায় পাঁচ বছর পর ১৮২৩সালে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতেও নাম দিতে চাননি মেরি শেলি। কিন্তু পার্সি শেলি ও অন্য বন্ধুদের অনুরোধে নাম প্রকাশে বাধা দেননি তিনি! পাঠকরাও জানতে পারলো এই রোমাঞ্চকর উপন্যাসের লেখিকা মেরি শেলি, পার্সি শেলি নয়। কেননা পাঠকরা এতিদিন ভেবেছিল এই উপন্যাসটি কবি পার্সি শেলি লিখেছেন। ১৮২২ সালে ল-নসহ আরও কয়েকটি শহরের বিখ্যাত থিয়েটারে মঞ্চায়িত হয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নাটক। এবং বিংশ শতাব্দীতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন রূপালী পর্দায় চিত্রায়িত হয়। ১৯৩১ সালে চিত্রায়িত বরিশ কার্লফের ফিল্ম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছিল। মেরি শেলির দুইশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০টি উপন্যাসের তালিকা করেছিল। যেখানে মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দশম স্থান দখল করে নেয়। মেরি শেলির আর একটি উপন্যাস দ্য লাস্ট ম্যান যেটাও খুব বিখ্যাত একটি উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু লেখার জগতে বিখ্যাত হলেও বাস্তব জীবনে দুঃখ, কষ্টের মধ্যে জীবন কেটেছে মেরি শেলির। জন্মের মাত্র ১১ দিনের মধ্যেই মেরি শেলি তাঁর মাকে হারান। প্রায় মার কবরের পাশে বই পড়তে দেখা যেত তাকে। তারপর তাঁর বাবা গডউইন মেরির ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর পরবর্তীকালে তাঁর বড় বোন ফ্যানি ইমলের সঙ্গে তিনি বেড়ে ওঠেন। সেই সময়ে অন্যান্য ইংরেজ নারীর মতো তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয়নি তাকে। তবে তাঁর বাবা উইলিয়াম গডউইনের প্রেরণায় লিখতে ও পড়তে শিখেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর পিতামাতার লেখা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন, তাঁর বাসার বিশাল লাইব্রেরী থেকে জ্ঞানচর্চা করেছেন প্রতিনিয়ত। এখান থেকে তাঁর বাবা ও মায়ের সংগ্রহ করা অসংখ্য বই পড়তেন তিনি। বিয়ের পর স্বামী কবি পার্সি শেলির থেকে গ্রিক, লাতিন এবং অন্যান্য ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন তিনি। লেখিকা হওয়ার পেছনে কবি পার্সি শেলির যথেষ্ট অবদান রয়েছে যা অস্বীকার করা যায় না। বিয়ের পরের বছর এক প্রতিবন্ধী কন্যা সন্তানকে জন্ম দেন মেরি। কিন্তু বেশিদিন আয়ু ছিল না তার কন্যার। এমনিতেই দারিদ্র্যতা তার ওপর সন্তানের মৃত্যু মেরি শেলিকে ভেঙে দিয়েছিল। ঠিক তখনই পার্সি শেলির প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয় এমন পর্যায়ে মেরি শেলির বাবা তাদের সম্পর্ক মেনে নেন এবং সামাজিক ভাবে বিয়ে দেন। ধীরে ধীরে জীবন গুছিয়ে নিতেই নৌকাডুবিতে মারা যান কবি পার্সি শেলি। মেরি শেলির বয়স তখন মাত্র চব্বিশ! স্বামীর মৃত্যু শোকে নিজ দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। তার কোলে তখন দুটা সন্তান। স্বামীর মৃত্যুর পর এই দুই সন্তানের ভরণপোষণে খুবই কষ্ট করতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দ্বিতীয় সন্তানকেও হারান তিনি। নিজ ভাগ্যকে মেনে নিয়ে পুনরায় লেখালেখিতে মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই সাথে স্বামী পার্সি বিশি শেলির কবিতা ও সাহিত্যকর্ম সমাজে প্রচারের কাজে নেমে পড়লেন। কবি পার্সিকে অনেক ভালবাসতেন তিনি। তাই নিজ সাহিত্য চর্চার চেয়ে স্বামীর সাহিত্যকর্ম প্রকাশ ও প্রচার করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। অথচ মেরি শেলি নিজেই একজন জনপ্রিয় উপন্যাসিক ছিলেন। সেটা তিনি লোকসমুক্ষে খুব কমই প্রকাশ করতেন। যেখানে যেতেন তিনি সর্বদা নিজেকে পার্সির স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিতেন। যেখানেই যেতেন স্বামী কবি পার্সি শেলির সাহিত্যকর্মের চর্চা করতেন। অথচ তিনি নিজেই বিখ্যাত এই বিষয়ে তার কোন ভ্রƒক্ষেপ ছিল না। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছাড়াও তিনি আরও ছয়টি উপন্যাস লিখেছেন, তিনটি শিশু সাহিত্য, অসংখ্য ছোট গল্প, ফিচার, রিভিও লিখেছেন। শেলির সঙ্গে ফ্রান্সে থাকাকালীন ঘটনা নিয়ে ১৮১৭ সালে ‘হিস্টোরি অব এ সিক্স উইকস ট্যুর’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও ১৮২৬ সালে ‘দ্য লাস্ট ম্যান’, ১৮৩০ সালে লেখা ‘লডোর’ এবং ১৮৩৭ সালে লেখা ‘ফকনার’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে অন্যতম। তাঁর লেখা শেষ পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হচ্ছে ‘র‌্যাম্বলস ইন ইতালি অ্যান্ড জার্মানি’, যা ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী লেখা ছিল তার প্রধান একটি শখ। মেরি শেলি প্রায় বাষট্টি জন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী লিখেছিলেন। পার্সি শেলিকে হারিয়ে দীর্ঘদিন মেরি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ছিলেন। ১৮৫১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু হয়। আর এভাবেই শেষ হয় ইতিহাসের দুঃসাহসী ও কালজয়ী এক নারী সাহিত্যিকের জীবনের অবসান।
×